১৯৭১, তখন আমার বয়স মাত্র চৌদ্দ শেষ করে পনেরোতে পা বাড়িয়েছে। টগবগে কিশোর আমি। পড়তে আর লিখতে ভীষণ ভালো লাগতো আমার। পড়াশোনাটাই ছিল আমার ধ্যান জ্ঞান। হঠাৎ একদিন চারিদিকে কানা ঘুসা শুনা যাচ্ছে। সবাই নাকি বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে! ঘরে ছিল আমার বাবা মা আর অতি আদরের ছোট বোন দিয়া। রাতে বাড়ির সকলে যখন ঘুমে তখন আমি চুপিসারে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাকাটাই একটা চক্কর দিলাম। মুরব্বিদের কথা শুনে গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠলো। আমার কি কিছু করার আছে? বাড়ি ফিরে এসে অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমিও যুদ্ধে যাব। আমার এ দায়িত্বটা পালন করতেই হবে। রাতের আঁধারে নিঃশব্দে ঘর ছাড়লাম। মুক্তি যুদ্ধের প্রয়োজনে যখন যেখানে যেতে হয় অবলিলায় চলে যাই। রাত দিন দুইটাই আমার কাছে শুধু দিনে পরিণত হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুর ভয় আমাকে পিছু হটাতে পারেনি। একদিন গভীর রাতে কান্নার শব্দে মনের ভেতরটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। জানিনা, কার কপাল পুঁড়ল? কান্নার শব্দ শোনার পর থেকে আমার দু’চোখের পাতা এক হয়নি। বাড়ির সবাইকে একটু দেখার জন্যে মন আনচান করছে। তাই সারারাত পায়চারী করে নির্ঘুমে কাটিয়ে দিলাম। খুব ভোরে পূব আকাশে সূর্য্যের আলো ফোটার আগেই বাড়িতে গেলাম। সবাই কেমন আছে? দেখতে গিয়ে যা দেখলাম, তার জন্যে আমি মোটেও তৈরী ছিলাম না। আমি মুক্তি যোদ্ধাদের ক্যাম্পে চলে গিয়েছি বলে। বাড়িতে আমাকে খুঁজতে এসে না পেয়ে জানোয়ারের দল রাজাকার বাহিনী আমার আদরের বোন দিয়াকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে। অতিরিক্ত পৈশাচিক অত্যাচারে আমার আদরের বোন প্রাণ হারালো। বাবা ওদের মোকাবেলা করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করল। ওরা আমার মা’রেও ছাড়ে নায়। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করছে। আমি তখন মাকে একটি কথাও বলতে পারি নাই। নিরবে শুধু চোখের পানি দরদরিয়ে ঝরেছে। মা শুধু আমারে বললো। বাবা, তুই প্রতিশোধ নিবি। রক্তের দামে দেশটারে বাঁচা। মায়ের জন্যে লড়াইয়ে যা বাবা। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। আমি মায়ের দোয়া আর ভালোবাসা নিয়ে ঘর ছেড়েছি। আর ফিরেছি বীরের বেশে মাথা উঁচু করে। লাল সবুজের পতাকা নিয়ে। বাংলাদেশের মানচিত্র বুকে নিয়ে। মায়ের জন্যে আমি ভালোবাসা এনে দিয়েছি। দেশের জন্যে নিজের ইজ্জত দিতে যাকে বাধ্য করেছিল আমি সেই মায়ের সন্তান। সেই মহতী মানবীকে আমি আমার বুকের জমিনে নির্ভরতার আশ্বাস দিয়ে ভালোবাসা আর মমতার চাদরে জড়িয়ে নিয়েছি। ত্রিশ লক্ষ মুক্তি যোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে। লক্ষ লক্ষ মা বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ। একটি লাল সবুজের পতাকা। একটি মানচিত্র। একটি ভূখণ্ড। পরাধীনতার ভার আগলা করে আজ আমরা ডানা মেলে মুক্ত বিহঙ্গে মতো উড়তে পারছি। স্বাধীনতা অর্জন করা যতোটাই না কঠিন ছিল তার চেয়ে বেশি কঠিন তার সন্মান রক্ষা করতে পারা। এ বিজয় ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মদানের বিজয়। এ বিজয় লক্ষ লক্ষ মা বোনদের সম্ভ্রম হারানোর বিজয়। তাই আমরা তাকে আগলে রাখবো সন্মান দিয়ে মর্যাদা ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে। আমার সোনার বাংলাদেশ। আমার মা। আমার সর্ব হারা জননী। আমাদের পরম বিশুদ্ধ যত্নে পাওয়া ইতিহাসের বিজয় মাল্য।
Leave a Reply