অটোয়ায় এখন ২৫ মার্চের সকাল। ঢাকায় এখন ২৫ মার্চের রাত। অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনির ভয়াল ভয়ংকর গণহত্যার কালরাত।
রাতটিকে স্মরণ করে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয় বাংলাদেশে। এবছর সরকারি এক তথ্যবিবরণীতে বলা হয়েছিলো গণহত্যা দিবসে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।
সেই অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এক মিনিটের ব্ল্যাকআউট এবং আলোর মিছিলের আয়োজন করেছিলো একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একই আয়োজন ছিলো সোহরাওয়ার্দি উদ্যানেও। সেখানেও ব্ল্যাক আউট চলাকালে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিলো কৃত্রিম কিছু মোমের আলো। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো দর্শকশ্রোতাদের অজস্র মোবাইল ফোনের আলোর কুসুম। অটোয়ায় বসে টিভি পর্দায় সরাসরি সম্প্রচারিত অপরূপ সেই দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই আমার স্মৃতিতে হামলে পড়লো আজ থেকে ২৮ বছর আগের এরকম এক রাতের ঘটনা–
সময়কাল ১৯৯৪।
তারিখ ২৫ মার্চ। সময় রাত ১২টা।
ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আমরা সমবেত হয়েছি শহিদ জননী জাহানারা ইমামের ডাকে। একটি আলোর মিছিল হবে তাঁর নেতৃত্বে। রাত বারোটা বাজার কিছু আগে তিনি এলেন। ছোট্ট একটি বক্তৃতা দিয়ে উদ্বোধন বা সূচনা করলেন আলোর মিছিলের। আমাদের প্রত্যেকের হাতে হাতে মোমবাতি। ভলান্টিয়াররা তাঁদের হাতে থাকা সিগারেট লাইটার দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন আগুন, হাতে হাতে।
জাহানারা ইমাম শহিদ মিনারের মূল বেদি থেকে নেমে এলেন মোমবাতি হাতে। আমাদের গন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ক্যাম্পাসের গণকবর। শহিদ জননীর খুব কাছাকাছি থাকা সত্বেও কি মনে করে আমি রওনা হলাম ত্রিশ চল্লিশ সেকেণ্ড ব্যবধানে। একটু পেছলে। আমি যেতে চাইলাম তাঁকে অনুসরণ করা সাধারণ মানুষের বিপুল জনস্রোতের সঙ্গে সঙ্গে।
প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি হাতে শহিদ মিনারের মূল বেদি থেকে নামতে নামতে রাস্তায় আসতেই বাতাসের ঝাপটায় আমার মোমবাতির শিখাটি গেলো নিভে। এর পরের দৃশ্যটা আমার স্মৃতিগদ্যের প্রথম বই ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘যত্রতত্র কয়েকছত্র’ থেকে উদ্ধৃত করছি–
{”আমার ঠিক ডানপাশেই খুব ধীর পদক্ষেপে জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সৌম্যকান্তি এক বৃদ্ধা। আমি তাঁর কাছে আগুন ধার চাইতেই পরম মমতায় তিনি আমার মোমবাতিটিতে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন অনির্বাণ শিখা। তারপর আমার মাথায় তাঁর স্নেহময় হাতের পরশ বুলোতে বুলোতে বলেছিলেন, তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি। তুমিও আমাকে নিশ্চয়ই চিনতে পারবে।
বিনীত ভঙ্গিতে আমি জানতে চেয়েছিলাম–কে আপনি?
অশ্রুসজল চোখে বলেছিলেন তিনি–শহিদ মানিকের মা আমি। একাত্তরের শহিদ মানিক।
–নয়াপল্টনের শহিদ মানিকের মা আপনি!?
আমার প্রশ্নে খুশি হয়ে বলেছিলেন তিনি–হ্যাঁ বাবা। আমিই সেই মানিকের মা। ওর স্মৃতিকে বহন করে এখনো বেঁচে আছি আমি। আজ এসেছি আরেক শহিদ জননীর ডাকে।
তাঁর দু’চোখে তখন থই থই করছিলো আবেগ। একাত্তরে সন্তান হারানোর বেদনাকে বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকাটা কতো যে কষ্টের সেটা আমরা কেমন করে বুঝবো? তাঁর অশ্রুসজল চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। সেই শহিদ জননীকে, শহিদ মানিকে মাকে শহিদ মিনারে দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেলো। তখন আমার ভেতরে কেবলই অনুরণিত হচ্ছিলো সেই গানটি–উই শ্যাল ওভারকাম…।” }
[সূত্র/ যত্রতত্র কয়েকছত্রঃ লুৎফর রহমান রিটন। প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরী। প্রকাশক আগামী প্রকাশনী। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০০১]
০২
আজ শহিদ মানিকের মাকে খুব মনে পড়ছিলো ঢাকায় আলোর মিছিলের খবরটা দেখার পর থেকে। একাত্তরের রণাঙ্গণে যুদ্ধ করতে করতে বুলেটবিদ্ধ হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। শহিদ মানিকের সহযোদ্ধা আমার প্রাণের বন্ধু সফিকুল ইসলাম স্বপনকে ফোন দিলাম।
২৮ বছর আগের এক ২৫ মার্চের রাতের আলোর মিছিলে আমার সঙ্গে দেখা হওয়া স্বপনের সহযোদ্ধা মানিকের মায়ের গল্পটা বললাম।
বললাম, সেদিন নিয়তিই আমাকে জাহানারা ইমামের সঙ্গে না নিয়ে একটু পেছনে সাধারণ মানুষের মিছিলে শামিল করিয়ে শহিদ মানিকের মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছিলো।
সেই রাতে তিনি আমাকে কীভাবে আলো দিয়েছিলেন, কীভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়েছিলেন সেই ঘটনা বলতে বলতে লক্ষ্য করলাম টেলিফোনের অপর প্রান্ত নিরব। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝতে পারলাম স্বপন ভাই কাঁদছেন।
খানিক পর বুঝলাম দুই প্রান্তে আমরা দুই বন্ধুই নিরব।
ওইপ্রান্তে স্বপন ভাই আর এইপ্রান্তে আমি, কাঁদছি আমরা দু’জনেই!
স্বপন ভাই হয়তো কাঁদছেন তাঁর সহযোদ্ধা শহিদ মানিকের জন্যে।
আর আমি কাঁদছি ২৫ মার্চ রাতে আলোর মিছিলে দেখা হওয়া শহিদ মানিকের মায়ের জন্যে।
আহারে একাত্তর…!
০৩
স্বাধীনতার পর শহিদ মানিককে(রেজাউল করিম মানিক) সম্মান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু নয়াপল্টনের সেকেণ্ড লেনটির নাম রেখেছিলেন শহিদ মানিক সড়ক। একটি নামফলকও ছিলো।
সফিকুল ইসলাম স্বপনও নয়াপল্টনের বাসিন্দা। খুব বেদনার্ত কণ্ঠে স্বপন ভাই জানালেন, আমি পুনে থেকে ফিরে এসে দেখি রণাঙ্গণে আমার লিডার শহিদ মানিকের নামটা আর নেই। সড়কটা আবার নয়াপল্টন সেকেণ্ড লেনই হয়ে গেছে।
পরবর্তীতে ঢাকার তৎকালীন মেয়র হানিফের কাছে শহিদ মানিকের নামে সড়কটির নামকরণের দাবিটি পেশ করেছিলেন স্বপন। মেয়র হানিফ তখন নাকি বলেছিলেন, সড়কের নাম পরিবর্তনে অনেজ ঝামেলা, তারচে বরং কিছুদিনের মধ্যেই এই এলাকায় যে কমিউনিটি সেন্টারটি উদ্বোধন করা হবে সেটার নাম আমি শহিদ মানিকের নামে করিয়ে দিচ্ছি।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মেয়র হানিফ তাঁর কথা রাখেননি।
কমিউনিটি সেন্টারটি তিনি উদ্বোধন করেছিলেন ঠিকই কিন্তু সেটা শহিদ মানিকের নামে নয়। কমিউনিটি সেন্টারটির নাম পল্টন কমিউনিটি সেন্টারই বহাল রেখেছিলেন মেয়র হানিফ।
এর বহুকাল পরে, অনেক আবেদন-নিবেদন-দৌড়ঝাঁপের পর পাঁচ-ছ বছর আগে মানিকের বাড়ির সামনে থেকে ফকিরাপুল বাজার হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত বিস্তৃত ভিআইপি রোডটির নাম অবশ্য শহিদ মানিক সড়ক রাখা হয়েছে।
জানি না শহিদ মানিকের মা আজ বেঁচে আছেন কী না। তিনি কি দেখে যেতে পেরেছিলেন তাঁর ছেলের রক্ত আর জীবনের দামে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের একটি সড়কের নাম শেষমেশ তাঁর পুত্রের নামে রাখা হয়েছে?
আমি জানি না।
আমরা কিছুই জানি না।
কিছুই মনে রাখি না আমরা।
আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন মা।
[ ক্যাপশন/ নয়াপল্টনে ঘরের দেয়ালে ফ্রেমবন্দি শহিদ মানিকের ছবি থেকে পরম মমতায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ধুলো মুছে দিচ্ছেন মানিকের মা। স্বাধীনতার পর মন বিষণ্ণ করা এই ছবিটি তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধা আলোকচিত্রী সফিকুল ইসলাম স্বপন। ]
Shafiqul Islam Swapan
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply