১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর, ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার বাড়িকে আলোকিত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার আদরের ছোট সন্তান হয়ে যে শিশুটি জন্ম
নিয়েছিল তাঁর নাম রাসেল। রাসেল নামকরণেরও একটি ইতিহাস আছে। বঙ্গবন্ধু মুজিবের বই পড়ার প্রতি ছিল প্রচুর নেশা। বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের ছিলেন একজন ভক্ত। বার্ট্রান্ড রাসেল শুধু দার্শনিকই ছিলেন না, ছিলেন বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি। ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের বিশ্বনেতা।
খুনিরা ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ও নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডে সপরিবারে
শিশু রাসেলকেও হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বুলেটের আঘাতে একবারই হত্যা করেছে। কিন্তু শিশু রাসেলকে বুলেটের আঘাতে হত্যার করার আগেই কয়েকবার হত্যা করেছে। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড আর কোথাও ঘটেনি। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিতে-নিতে শিশু রাসেলকে প্রতিটি লাশের সামনে মানসিকভাবেও খুন করেছে। একান্ত আপনজনের রক্তমাখা নিরব, নিথর দেহগুলোর পাশে নিয়ে গিয়ে শিশু রাসেলকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল, জঘন্য
কর্মকাণ্ডের দৃশ্যগুলো দেখিয়ে তাকে ভেতর থেকেও হত্যা করে সর্বশেষে বুলেটের নির্মম আঘাতে রাসেলের দেহ থেকে অবশিষ্ট প্রাণ
ভোমরাটিকেও চিরতরের জন্য নিরব-নিস্তব্ধ করে দিয়েছে বর্বর খুনিরা।
বাবা মুজিব হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর ছোট ছেলে আপন প্রতিভায় একদিন দীপ্ত হয়ে উঠবে। হবেন লেখক, দার্শনিক কিংবা বিশ্বশান্তির নতুন কোন কান্ডারী।ছোট্ট শহীদ রাসেলের স্বল্প সময়ের জীবন বিশ্লেষন করলে
আমরা সেটাই দেখতে পাই। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী,মানবিক ও রাজনৈতিক বোধ সম্পন্ন একজন ব্যক্তি।
রাসেল পিতার সান্নিধ্য বেশি না পেলেও যখন পেতেন তখনই পিতাকে সবসময় অনুকরণ ও অনুসরণ করতেন।পিতার জামা-জুতা হাঁটার ষ্টাইল সব কিছুই অনুকরণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পোশাক ছিল লুঙ্গি ও গেঞ্জি। সেজন্য রাসেলেরও ছোট লুঙ্গি ছিল। বঙ্গবন্ধুর চশমাটা মাঝে মাঝে নিজের চোখে নিয়ে মজা করত। বঙ্গবন্ধুও যখন সময় পেয়েছেন তখনই রাসেলকে সময় দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বিভিন্ন দেশ সফরে যেতেন তখন রাসেলকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। রাসেল ছিল খুবেই চঞ্চল প্রকৃতির। সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখত। চার বছর বয়সে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র হিসেবে শিক্ষা জীবন শুরু হয়। দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়,মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে শেখ রাসেলের জন্য একজন গৃহ শিক্ষিকা রাখা হয়। তিনি ছিলেন গীতালি দাসগুপ্তা। চঞ্চল প্রকৃতির রাসেলের কথাই শিক্ষিকাকে শুনতে হতো,নইলে সে পড়াশুনা করতে মনোযোগী হতো না। শিক্ষিকাও আদর করে তাঁকে ম্যানেজ করেই শিক্ষাদান করতেন। শিক্ষিকা যখন পড়াতে আসতেন তখনই তাকে বাধ্যতামূলক দুটো মিষ্টি খেতে হতো, তিনি খেতে না চাইলে,রাসেলও বই পড়তে চাইতেন না। এভাবেই চলছিল শেখ রাসেলের বাল্যকাল। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মা’র সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিল রাসেল।’
শহীদ রাসেলের মৃত্যুর দিনটিও পিতার আদর্শে উজ্জ্বল হওয়ার কথা ছিল।১৫ আগস্ট সমাবর্তন উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল আচার্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট জানানোর জন্য বাছাই করা হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ৬ জন সদস্যকে। তাদের মধ্যে অন্যতম চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শেখ রিসালউদ্দিন(রাসেল)। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তাঁর আর স্যালুট জানানো হয়নি। সেদিন যদি শেখ রাসেল শহীদ না হতেন তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর প্রিয় হাসু আপার পাশে থেকে আধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণে পাশে থেকে কাজ করতেন।
ড. মো. আজহারুল ইসলাম
Leave a Reply