সূচিত্রা সেনের মৃত্যুর পর ১০ বছর কেটে গেল। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। বুধবার তাঁর প্রয়াণ দিবসে সূচিত্রা সেনকে নিয়ে এক অনবদ্য স্মৃতিচারণ করলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এক সময়ের জনপ্রিয় নায়ক আলমগীর।
আলমগীরের সেই স্মৃতিচারণ প্রকাশিত হয়েছে একটি বহুলপ্রচারিত পত্রিকায়। আলমগীর জানিয়েছেন, তাঁর দেখা উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত প্রথম ছবি ছিল ‘হারানো সুর’। তখন তিনি খুব ছোট। তার পর ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কলকাতার ছবি দেখানো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেই ছোট থেকে তাঁর ইচ্ছা ছিল একবার যদি উত্তমকুমার আর সূচিত্রা সেনকে সামনে থেকে দেখা যায়।
আলমগীরের নামের অর্থ যিনি বিশ্বজয়ী। তবে তাঁর অর্ধেক ইচ্ছাপূরণ হয়েছিল। উত্তমকুমারকে সামনে থেকে কোনওদিন দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু অন্তরালে থাকা সূচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে তিন বার। সেই রোমাঞ্চকর স্মৃতিচারণ করেছেন আলমগীর।
বাংলাদেশের এই নায়কের অভিনীত ‘সত্য মিথ্যা’ ছবিটি সুপারহিট হয়েছিল। পরিচালক ছিলেন এ জে মিন্টু। সেই ছবির সাফল্য দেখে ১৯৮৯ সালে কলকাতায় ছবিটির রিমেক করার কথা ভাবেন প্রযোজক বিজয় খেমকা। সেই কারণেই কলকাতায় এসেছিলেন আলমগীর।
মহানগরীতে পৌঁছেই আলমগীর ঠিক করে নিয়েছিলেন যে কোনও উপায়ে সূচিত্রা সেনের সঙ্গে তিনি দেখা করবেনই। ‘সত্য মিথ্যা’ ছবিটিতে কাজ করার সুবাদে অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। তাঁকেই প্রথমে অনুরোধ করেছিলেন আলমগীর। বলেছিলেন, সুচিত্রা সেনকে একবার দেখতে চাই, আপনি যদি ব্যবস্থা করে দেন তো খুব ভাল হয়। শুনেই নাকি চমকে ওঠেন সন্ধ্যা রায়! এ ছেলে বলে কী! না রে, ওটা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন সন্ধ্যা রায়।
এরপর আলমগীর ধরেন সুপ্রিয়া দেবীকে। তাঁর সঙ্গেও আগে থেকে পরিচয় ছিল। একবার ঢাকায় গিয়ে আলমগীরের বাড়িতে ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। সুপ্রিয়াকে ফোন করে আলমগীর দেখা করতে চান। শুনেই সুপ্রিয়া বলেন, চলে আয়। অনেক আড্ডার পর আলমগীর তাঁকে বলেন, দিদি মিসেস সেনের সঙ্গে দেখা করতে চাই। সেটা কি সম্ভব হবে? তাঁর কথা শুনে সুপ্রিয়া বলেছিলেন, কলকাতায় তুই যা জিনিস চাইবি, এনে দেব, কিন্তু এটা তো একেবারেই হবে না।
সুপ্রিয়া হাত তুলে দেওয়ায় আলমগীর ধরেন রঞ্জিত মল্লিককে। কিন্তু রঞ্জিত মল্লিকেরও সাধ্য ছিল না সেই সুযোগ করে দেওয়ার। তবে এক প্রযোজক আলমগীরকে পরামর্শ দেন আর এক প্রযোজক রত্না দেবীর সঙ্গে কথা বলতে। কারণ, উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনকে নিয়ে তিনি ছবি বানিয়েছিলেন। রত্না থাকতেন বেহালায়। তিনি বাংলাদেশের ছবির খবর রাখতেন বলে আলমগীরকে চিনতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। কিন্তু সুচিত্রা সেনের সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া যে তাঁরও কম্ম নয়, স্পষ্ট জানিয়ে দেন রত্না।
এর পর কলকাতায় আলমগীরের এক ব্যবসায়ী বন্ধু তাঁকে পরামর্শ দেন, সোজা সুচিত্রা সেনের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে চলে যেতে। তার পর কার্ড পাঠিয়ে দেখা করার আবদার জানাতে। আলমগীর সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তাই করেছিলেন তিনি। বাড়ির গেটে পৌঁছে নিজের ভিজিটিং কার্ড বের করেন। তাতে লেখেন, দিদি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, তোমার দর্শনপ্রার্থী।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে সুচিত্রা সেন
দারোয়ানের হাতে কার্ডটা দিয়ে সুচিত্রাকে পৌঁছে দিতে বলেন আলমগীর। প্রায় আধ ঘণ্টা পর দারোয়ান ফিরে এসে বলেন, পরদিন সকাল ১০টায় ফোন করতে। কার্ডে নম্বরটা লিখে পাঠানো হয়েছিল বাড়ির ভিতর থেকে।
পরদিন সকালে ঘড়ি ধরে ১০ টাতেই ফোন করেন আলমগীর। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, দিদির সঙ্গে কথা বলতে চাই। তখন ও প্রান্ত থেকে ভেসে আমি তোমার দিদিই বলছি।
আলমগীরের তখন যেন স্থবির হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। পাঁচ-ছ’ মিনিট ফোনে কথা হয়। তার পর সাহস করে বলে ফেলেন, দিদি, একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। ‘এবার নয়’ বলে প্রথমে এড়িয়ে যেতে চান সুচিত্রা। বলে ব্যস্ততা রয়েছে। পরের বার এলে দেখা হবে। শুনে আলমগীর বলেন, আপনি কদিন ব্যস্ত থাকবেন, ১০ দিন- ১৫ দিন- ২০ দিন? আমি না দেখা করে কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছি না।
আলমগীরের কথায়, এ কথা শুনে সুচিত্রা নরম হন। তারপর বলেন, আজকে তো থার্টি ফার্স্ট। পার্টি করবে নিশ্চয়ই। তাহলে তার আগে সন্ধে ৬টার সময়ে এসো। তোমাকে ১৫ মিনিট সময় দেব। তবে পই পই করে জানিয়ে দেন, সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাওয়া চলবে না, ক্যামেরা সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যাবে না আর ব্যক্তিগত ব্যাপারে কিছু জানতে চাওয়া চলবে না।
আলমগীর সবেতে হ্যাঁ হ্যাঁ করে যান। কলকাতায় তাঁর সেই সফরে সঙ্গী ছিলেন ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্নার’ পরিচালক আব্বাস। সে তখন বায়না শুরু করে, সঙ্গে যাবে। কিন্তু তার উপায় ছিল না।
৬টা বাজার আগেই বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে পৌঁছে যান আলমগীর। বড় বাড়ি। সামনে কিছুটা সবুজ লন ছিল। গেটে পৌঁছতেই দারোয়ান তাঁকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নিয়ে যান। দোতলায় উঠেই বড় বারান্দা। সেই বারান্দায় বেশ কয়েকটা সোফা রাখা ছিল। তারই একটায় দারোয়ান তাঁকে বসতে বলে চলে যান। উৎকন্ঠায় যেন তখন গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আলমগীরের। একটু পর তিনি জুতোর হিলের শব্দ শুনতে পান। ঘাড় ঘোরাতেই দেখেন হাল্কা কলাপাতা রঙের একটি শাড়ি পরা এক ভদ্রমহিলা তাঁর দিকে হেঁটে আসছেন। দেখে উঠে দাঁড়ান আলমগীর।
সুচিত্রা আলমগীরকে দেখেই হাতজোড় করে নমস্কার করেন। সেভাবেই হেঁটে আসেন বাকিটা। কাছে এলে তাঁকে প্রণাম করতে যান আলমগীর। কিন্তু তিনি ধরেন ফেলেন। তখন আলমগীরের নাকি হাঁটু কাঁপছে। সুচিত্রা সেন তাঁকে স্পর্শ করেছেন, যেন ভাবতেই পারছেন না। যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
আলমগীর সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সুচিত্রা তাঁকে প্রশ্ন করেন। তুমি আমাকে প্রণাম কেন করলে? শুনে আলমগীর বলেন, বাহ একটু পায়ের ধুলো নেব না! তা শুনে সুচিত্রা সেন বলেন, তুমি একজন শিল্পী। তুমি যদি আমাকে প্রণাম করতে পারো, তাহলে আমারও তোমাকে প্রণাম করা উচিত। কারণ, শিল্পীর কোনও ছোট-বড় নেই। আলমগীর কী বলবেন ভেবে পান না। বলেন, আপনি হলেন দিদি। বড় দিদি হিসাবে প্রণাম করেছি। ‘তাহলে ঠিক আছে’ বলে সোফায় বসেন সুচিত্রা।
আলমগীরের কথায়, এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনও মহিলাকে তিনি তার আগে কখনও দেখেননি। তাঁর ছবি ও বাস্তব যেন মিশে গেছে। হাসিতে সেই সৌন্দর্য আর মায়া।
আলমগীর জানিয়েছেন, সুচিত্রা তাঁর থেকে বাংলাদেশের ছবির খোঁজ নেন। অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের কুশল সংবাদ নেন। তার পর রাজ্জাক-কবরীরের কুশল জানতে চান।
আলমগীর দাবি করেছেন, তিনি নাকি সুচিত্রাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এই একাকিত্ব বেছে নেওয়া কেন? তা শুনে সুচিত্রা হেসে বলেছিলেন, কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয় বলেছিলাম তো।
সুচিত্রা এর পর আলমগীরের জন্য চা নিয়ে আসেন। ট্রেতে রাখা চা, কয়েকটি কুকিজ আর তিনটি নারেকেলের নাড়ু। মুশকিল হল, আলমগীর আবার নারকেল দিয়ে বানানো কোনও খাবার খান না। নাড়ু খাচ্ছেন না দেখে সুচিত্রা বলেন, ওগুলো খাও। আমার বানানো নারকেল নাড়ু। নিজ হাতে বানিয়েছি।
যে মানুষটা নারকেলের তৈরি কিছু খান না, সেই আলমগীর এর পর আর দেরি করেননি। তিনটি নারকেল নাড়ু টপাটপ খেয়ে নেন। কিন্তু প্রশ্ন করা ছাড়েননি বাংলাদেশের তৎকালীন নায়ক। জানতে চান, সুচিত্রা অভিনয় ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন? আলমগীরের দাবি, সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘ডিরেক্টর কোথায়?’ আর কিছু না।
এই সব কথার মধ্যেই সুচিত্রা নাকি একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলেন। তার পর বলেন, আচ্ছা বাংলাদেশে লুকিয়ে যেতে পারব? কেউ কি চিনে ফেলবে আমাকে?
আলমগীর সে কথা শুনে বলেন, আপনাকে চিনতে পারবে না, হয় নাকি! সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছিলেন সুচিত্রা। তারপর হাসতে হাসতে বলেন, ঘোমটায় মুখ লুকিয়ে যাব।
এখানে আলমগীরকে একবার তুই বলেও সম্মোধন করেন সুচিত্রা। তিনি বলেন, তুই আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে তোর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখবি।
সুচিত্রা যশোর ও পাবনা যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। প্রথমে যশোর তারপর পাবনা। তিনি পাবনার মেয়ে, প্রথমে যশোরে যাওয়ার ইচ্ছা শুনে আলমগীরের কৌতূহল হয়। তিনি জানতে চান, পাবনার মেয়ে হয়ে আগে যশোর কেন? জবাবে সুচিত্রা নাকি বলেন, তাঁর জন্ম এবং পড়াশোনা পাবনায়। কিন্তু পৈতৃক ভিটে যশোরে। সেটা দেখার খুব ইচ্ছে তাঁর।
১৫ মিনিটের জন্য সময় দিয়েছিলেন সুচিত্রা। কিন্তু গল্প করতে করতে ১ ঘণ্টা কেটে যায়। আলমগীর এর পর বুদ্ধি করে বলেন, পরের মাসে ফের কলকাতায় আসবেন তিনি। তখন বাংলাদেশ থেকে কিছু আনতে হবে কিনা। যাতে সেই অছিলায় ফের দেখা হয়। কিন্তু সুচিত্রা না থাক বলে প্রথমে কাটিয়ে দেন। পরে পিছন থেকে ডেকে বলে শোন, তোকে যখন ভাই বানিয়েছি, তখন কিছু চাওয়াই যায়। পারলে আমাকে মরণচাঁদের দই এনে খাওয়াস।
পরের মাসে কলকাতায় আসার সময়ে সুচিত্রার জন্য মরণচাঁদের দই এবং এক কার্টন সিগারেট নিয়ে গেছিলেন আলমগীর। তারপর সুচিত্রাকে দইয়ের কথাটা জানান। শুনেই সুচিত্রা বলেন, ওটা আগে ফ্রিজে রাখো। সন্ধেবেলা নিয়ে এসো। সেদিন অবশ্য সুচিত্রার তাড়া ছিল। বাইরে কোথাও যাবেন। তাই আর কথা বিশেষ হয়নি।
তারপর আরও একবার কলকাতায় শুটিংয়ে আসার সময়ে সুচিত্রার জন্য ঢাকা থেকে দই নিয়ে আসেন আলমগীর। সেবারও অনেকটা সময় তাঁর সঙ্গে গল্প করার সুযোগ পান এই অভিনেতা।
কিন্তু চতুর্থবার দই নিয়ে এলেও আর দেখা হয়নি। সুচিত্রা জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেবার দেখা হবে না। বাইরে যাচ্ছেন। তবে দইটা যেন বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। আলমগীর তাই করেছিলেন।
এর পর আর তাঁর সঙ্গে সুচিত্রার দেখা হয়নি। ফোনে কথা হয়েছিল দু-একবার। তবে দই আর আনতে মানা করেছিলেন সুচিত্রা। বলেছিলেন, দই খেলে এখন তাঁর অসুবিধা হয়।
Leave a Reply