পুরান ঢাকায় প্রায়ই ৪০০ বছর আগের একটি স্হাপনা আজও খুব অবহেলার মধ্য দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তা হল জিঞ্জিরা প্রাসাদ।
এটি একটি প্রাচীন পুরাকীর্তি।
১৬৮৯- ১৬৯৭ খৃস্টাব্দে এটি তৈরি করেন নওয়াব ইব্রাহিম খাঁ। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে শহর থেকে জিঞ্জিরায় চলাচলের জন্য একটি কাঠের পুলও ছিল।
পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত নবাব সিরাজ পরিবার পরিজনকে এখানে পাঠানো হয়। আর সেই সাথে নবাব আলীবর্দি খাঁয়ের দুই মেয়ে ঘষেটি বেগম ও আমেনা বেগমকেও এখানে আনা হয়। সিরাজদ্দৌলার বেগম লুৎফুন্নেছা ও তার শিশু কন্যাকে মীরজাফরের পুত্র মীরনের নিদেশ এখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এখানে তাদের কাটে প্রায়ই আট বছর । নবাব সিরাজের পতনের আগ পযন্ত যড়যন্ত্রকারীরা ঘষেটি বেগমকে ব্যবহার করলেও সিরাজের পতনের পর তাকে আর কোন সুযোগই দেয়া হয়নি। জিঞ্জিরা প্রাসাদে তাদের কিছু দিন বন্দী অবস্থায় রাখা হলেও মীরজাফর পুত্র মীরনের নিদেশ এ ঘষেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে ধলেশ্বরী নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান ক্লাইভের হস্তক্ষেপের ফলে নবাব সিরাজের পরিবার রক্ষা পান ও তাদের পরে মূশিদাবাদে আনা হয়। ইংরেজ শাসন কোম্পানির সামান্য অনুদানের উপর ভিত্তি করেই তাদের জীবন ধারণ করতে হত। নবাব সিরাজের মৃত্যুর ৩৪ বছর পর লুৎফুন্নেছা ১৭৯০ সালে মারা যান।
প্রাসাদটির গঠন কাঠামো বড় কাটরার মতো হলেও কক্ষ ও আয়তন অনেক কম। পশ্চিমাংশের দুটো সমান্তরাল গম্বুজ, মাঝ বরাবর ঢাকনাবিহীন অন্য একটি গম্বুজ ও পূর্বাংশে ছাদ থেকে একটি সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। স্হানীয়রা একে “হাবেলী নগর” বলে। “জিঞ্জিরা” শব্দটি আরবী জাজিরা শব্দের বিকৃত রূপ। এক সময় জায়গাটি নদী ও পরিখা দিয়ে পরিবেষ্টিত
হওয়ায় এ রকম নামকরণ বলে জানা যায়। এ প্রাসাদের ৩ টি বিশেষ অংশ আজও আংশিক টিকে আছে৷ তা হল প্রবেশ তোরন, পৃথক দুটি স্হানে দু’টি পৃথক প্রাসাদ, একটি দেখতে ফাঁসির মঞ্চ ও অন্যটি প্রমোদাগার। কয়েক একর জমির উপর তৈরী করা হয়েছিল অবকাশ যাপন ও চিত্তবিনোদনের প্রান্তনিবাস হিসেবে।
এক সময় এটি ছিল নারিকেল, সুপারি,আম,কাঠালসহ দেশীয় গাছ গাছালীর সমারোহে ফুলে ফুলে শোভিত অপূর্ব কারুকাজখচিত মোঘল আমলের স্হাপত্যশৈলীর অনুপম সৃষ্টি। স্হানীয়দের মতে, মোঘল আমলে লালবাগ দূগের সাথে জিঞ্জিরা প্রাসাদের যোগাযোগ রক্ষার জন্য বুড়িগঙ্গার তলদেশ দিয়ে একটি সুরঙ্গ পথ তৈরী করা হয়েছিল। এ পথে মোঘল সেনাপতি আর শীর্ষস্হানীয়রা আসা যাওয়া করত। লালবাগ দূ্গেরও এমন একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
এখানে দেয়ালের আস্তর খসে বেড়িয়ে পড়ছে পুরান দিনের ইট। প্রকোষ্টগুলো খুব অন্ধকার। চারিদিক দিয়ে মাথা ফুঁড়ে বেড়িয়েছে পাঁচতলা ছয়তলা অসংখ্য ভবন।তাই কাছে না গেলে প্রাচীন এ ভবনটির অস্তিত্ব বোঝা যায় না।
এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত “ঢাকা কোষ”
বইয়ের তথ্যানুসারে, ১৭০৪ সালে মুশিদকুলী খান বাংলার দেওয়ানি মুশিদাবাদে সরিয়ে নিলে জিঞ্জিরা প্রাসাদের অবনতি শুরু হয়।
অনেক বেদনাবিধুর ঘটনার নিরব সাক্ষী এ জিঞ্জিরা প্রসাদ। এক সময় নদীপথেও এখানে আসা যেত। কিন্তু এখন পায়ে হেঁটেই সরাসরি এখানে আসা যায়।
কিন্তু স্হানীয়রা অতিথিদের খুব একটা সাদরে গ্রহণ করে না। বেশ কিছু জায়গা বেদখল হয়ে গেছে। যারা দখল করে নিয়েছে, তারা স্হানীয়ও ছাড়া কাওকেই ভিতরে প্রবেশ করতে দেয় না। তাই ভিতরে গিয়ে জিঞ্জিরা প্রাসাদ দেখা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
তারপরও কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে প্রায়ই ৪০০ বছর আগের প্রাচীন এ ভবনটি ।।
আমি বেশ কষ্ট করেই ভেতরে ঢুকি, সেই সাথে কিছু ছবি ঝটপট ক্যামেরা বন্দী করে ফেলি।।
Leave a Reply