বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টরটা আজব এক ভুলভুলাইয়া।
নিকট অতীতে আমরা দেখেছি এই সেক্টরে যার শ্রমিক হবার কথা সে হয় শ্রমিক নেতা। যার হবার কথা শ্রমিক নেতা সে হয় পরিবহন কোম্পানির মালিক। যার হবার কথা পরিবহন কোম্পানির মালিক সে হয় প্রশাসনযন্ত্রে সেই সেক্টরের বড় কর্তা।
সকালে যে শ্রমিক নেতা দুপুরে সে এম্পি। বিকেল গড়ালে সে-ই আবার মন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত।
সকালে শ্রমিকদের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিনামা সে-ই উত্থাপন করে। তাতে সে শ্রমিকদের স্বার্থ তো দেখেই, মালিকদের স্বার্থটাও দেখে তারচে বেশি।
তারপর দাবিনামা পেশ করা হয় তারই মন্ত্রণালয়ে। অতঃপর সচিব হয়ে সেই দাবিনামায় স্বাক্ষর করে সেটা পেশ করে মন্ত্রীর টেবিলে। তারপর মন্ত্রী হিশেবে মালিকদের স্বার্থ রক্ষার দাবিসমূহকে যৌক্তিক বিবেচনায় তাতে সাক্ষর এবং সিলছাপ্পড় মেরে দিয়ে কাহিনি ফাইনাল করে।
শুরু থেকেই এতোগুলো ধাপের সবক’টাতেই জোড়ালোভাবে রক্ষিত হয় মালিকপক্ষের স্বার্থটাই। এতোগুলো ধাপের কোনো একটাতেও রক্ষিত হয় না যাত্রী তথা সাধারণ জনগণের কোনো স্বার্থ বা অধিকার। অগনণ সাধারণ মানুষ দিনশেষে এই সেক্টরের জিম্মি হিশেবে কাফ্ফারা দিতে থাকেন। কারণ এতোগুলো ধাপের কোনো একটাতেও যাত্রী বা সাধারণ মানুষদের হয়ে কথা বলার কোনো প্রতিনিধি থাকে না। এখানে গণপ্রতিনিধি হিশেবে যে থাকে সে আসলে কোনো পরিবহণ কোম্পানির মালিক। সচিবও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একই রকম কোম্পানির দূরবর্তী বা অদৃশ্য কোনো মালিক। মন্ত্রীও তাই।
সুতরাং দিনশেষে কোটি কোটি মানুষকে জিম্মি করে তাঁদের অসহায়ত্বকে পূঁজি করে আরো হৃষ্টপুষ্ট হয় মালিকপক্ষ। ব্যবসায়ীরা মুনাফার কথাই মাথায় রাখবে, সেটাই দস্তুর। সুতরাং এই পরিবহণ ব্যবসায় দিন শেষে মুনাফা শুধুই মালিকপক্ষের।
০২
ছাত্ররা হাফ ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন করছে।
ছাত্রদের এই হাফ ভাড়ার দাবিটা যৌক্তিক।
ছাত্র জীবনে স্বাধীনতার আগে পরে এই হাফ ভাড়ার সুযোগ আমরা কে পাইনি? নেতা-এম্পি-মন্ত্রী-আমলা-ব্যবয়ায়ী-সকলেই পেয়েছি। বর্তমান ছাত্রছাত্রীরাও সেই অধিকার চাইতেই পারে। অতীত কালের ছাত্রছাত্রী হিশেবে আমরা যা পেয়েছি, বর্তমানের ছাত্রছাত্রীদেরও সেই সুযোগ থাকতে হবে।
শর্ত সাপেক্ষে হাফ ভাড়ার কৌশলটা যে উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েছে সেটা উদ্ভট রকমের হাস্যকর। ভজঘট লাগানো।
সকাল সাতটা থেকে রাত আটটা মানে কি? যে ছাত্র সে ভোর ছয়টাতেও ছাত্র আবার রাত আটটার পরেও ছাত্র। শুক্র-শনি-রবি সাত দিনই ছাত্র।
সপ্তাহের সাতদিনের প্রতিদিনের ২৪ ঘন্টাই ছাত্র। সারা মাস সারা বছরই ছাত্র।
সকাল সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ছাত্র নয়।
এইসব আংশিক প্যাঁচ লাগিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার কোনো মানে হয় না।
তাছাড়া ‘কেবলমাত্র ঢাকার ছাত্রছাত্রীদের জন্যে’ কথাটার অর্থ কি?
ছাত্রছাত্রীরা সবাই ঢাকায় বা রাজধানীতে থাকে না। শুধু ঢাকা সিটির ছাত্রছাত্রীরাই ‘ছাত্রছাত্রী’?
সারা দেশের ছেলেমেয়েরা তাহলে কি?
বৈষম্যের এই দৃষ্টিভঙ্গিটি নিন্দনীয়। অমার্জনীয়।
হাফ ভাড়া সারা দেশের সকল ছাত্রছাত্রীরই প্রাপ্য।
সরকারি কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন–সকল পরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করতে হবে।
ছাত্রছাত্রীদের হাফ ভাড়ার যৌক্তিক দাবিটার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন।
দেশটা শুধু ব্যবসায়ীদের নয়।
দেশটা সাধারণ জনগণের।
দেশটা সবার।
৩০ নভেম্বর ২০২১
[ছবি/ বিডিনিউজ২৪.কম]
Leave a Reply