৭ই মার্চ ১৯৭১ বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। এ দিন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার সমাবেশে তাঁর জাতির উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রাখেন- ইতিহাসখ্যাত ৭ই মার্চের ভাষণ। তৎকালীন পাকিস্তানের জনগণই শুধু নয়, সারা বিশ্বের মানুষ ঔৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে ছিল- বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে কী বলেন। ঢাকায় তখন বিদেশি সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রপত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য সেটি ছিল এক অন্তিম মুহূর্ত।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ একটি জাতি-জনগোষ্ঠীর মুক্তির কালজয়ী সৃষ্টি, এক মহাকাব্য। বহুমাত্রিকতায় তা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্ব মানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল বা সম্পদ। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে এটিই স্বীকৃত।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিসে অনুষ্ঠিত এর দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে ৩০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা/বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক দুবছর ধরে প্রামাণ্য দালিলিক যাচাই-বাছাই শেষে ইউনেস্কোর সেক্রেটারি জেনারেলের সম্মতিক্রমে এটি সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পরে হলেও জাতিসংঘের মতো বিশ্বসংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
তবে সম্প্রতি আরেকটি ভিন্ন কারণে আলোচনায় এসেছে ঐতিহাসিক এই ভাষণটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে একটি তথ্য, আর এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা, কৌতূহল জাগছে মানুষের মনে। ফেসবুকে ‘সিনেমাখোরদের আড্ডা’ নামক একটি পেইজের এক পোস্টে দেখা যায় ঐতিহাসিক সাতই মার্চের যে ভাষণটি আমরা দেখতে পাই, সেটি ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন আশি-নব্বই দশকের জনপ্রিয় অভিনেতা আবুল খায়ের। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায় বেশ কিছু তথ্য, যা হয়তো অভিনেতা আবুল খায়েরের অনেক ভক্ত-অনুরাগীরাই জানেন না।
সাতই মার্চের ঐতিহাসিক এই ভাষণ নিয়ে ব্যাপক পূর্ব প্রস্তুতি থাকলেও, পরিকল্পনামাফিক ভাষণটির অডিও-ভিডিও ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা বেতার থেকে এ ভাষণ প্রচার করার কথা ছিল, কিন্তু পাকিস্তান সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে সেদিন রেডিওতে তা প্রচার করা যায়নি। বঙ্গবন্ধু সেদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বক্তব্য রাখতে পারেন, এ আশায় রেসকোর্সের ময়দান জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। আজকের মতো এত আধুনিক টেকনোলজি মজুদ না থাকলেও সেদিনের জনসভার ভাষণটি বেতারে প্রচার করার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পূর্ণ ছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয়নি।
তবে সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যান এ এইচ এম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের এমএনএ ভাষণটি ধারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এম আবুল খায়ের এমএনএ ছিলেন তৎকালীন ফরিদপুর জেলার পাঁচ আসনের (বর্তমান গোপালগঞ্জ ১ আসন) নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তাদের এ কাজে সাহায্য করেন অভিনেতা আবুল খায়ের। তিনি তখন সরকারের ফিল্ম ডিভিশনের ডিএফপি কর্মকর্তার পাশাপাশি একজন অভিজ্ঞ সচল ক্যামেরা বিশেষজ্ঞও ছিলেন। তাদের সঙ্গে আরো যুক্ত হলেন অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান এনএইচ খন্দকার।
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার সময় এমএনএ আবুল খায়েরের তত্ত্বাবধানে টেকনিশিয়ান এনএইচ খন্দকার মঞ্চের নিচ থেকে ভাষণটির অডিও ধারণের সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে অভিনেতা আবুল খায়ের মঞ্চের এক পাশ থেকে সচল ক্যামেরা নিয়ে ঐ ভাষণের চিত্রধারণ করেন। কিন্তু ঐ সময়ের ক্যামেরাগুলো বেশ বড় আকার হওয়ার কারণে আবুল খায়েরের একার পক্ষে সেটা নাড়াচাড়া করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছিল, ফলে এক জায়গায় স্থির থেকে তিনি যতটুকু পেরেছেন, ধারণ করেছিলেন। আর এ কারণেই সাতই মার্চের ১০ মিনিটের একটি ভিডিও চিত্র আমরা দেখে থাকি। অন্যদিকে সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে বেতার কর্মীরা সরাসরি ভাষণটি প্রচার করতে না পারলেও; রেকর্ডটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন, যেটা পরদিন বাঙালি বেতারকর্মী ও আপামর জনতার দাবির প্রেক্ষিতে বেতারে প্রচার করা হয়।
এ প্রসঙ্গে এম আবুল খায়ের এমএনএ এর পুত্র বিশিষ্ট নজরুল সংগীতশিল্পী খাইরুল আনাম শাকিল এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ‘আমার বাবা আবুল খায়ের ও অভিনেতা আবুল খায়ের ছিলেন দুই বন্ধু। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ প্রচারে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা মঞ্চের নিচে লুকিয়ে ঐ ভাষণের অডিও-ভিডিও ধারণ করেছিলেন। আমার বাবার একটি রেকর্ড কোম্পানি ছিল ‘ঢাকা রেকর্ড’ নামের, ফলে তিনি অডিও রেকর্ডের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, অন্যদিকে অভিনেতা আবুল খায়েরের যেহেতু ক্যামেরা জ্ঞান ভালো ছিল, তাই তিনি ভিডিও চিত্র ধারণ করেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে এ ধারণকৃত অডিও-ভিডিও তাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময় এর কয়েকটি রেকর্ডেড কপি ভারতে পাঠানো হয়, সেখান থেকে বিশ্বখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি এইচএমভির উদ্যোগে এ ভাষণের তিন হাজার কপি বিনামূল্যে বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করা হয়’।
যারা আবুল খায়েরকে শুধুমাত্র অভিনেতা হিসেবেই জানেন, তাদের জন্য হয়তো এ তথ্যটি বেশ চমকপ্রদ। উল্লেখ্য নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নাটকের মাধ্যমেই অভিনয় জগতে জনপ্রিয়তা লাভ করেন আবুল খায়ের। তিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋতিক কুমার ঘটকের পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। এছাড়া, চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনি চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply