1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন

আমি তো টাকা জমাই না, আনন্দ জমাই

  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ১৭৮ বার
সারা দেশের পাঠাগারে বই পাঠান কাজী এমদাদুল হক খোকন। এ পর্যন্ত ৫১৬টি পাঠাগারে ৩০ হাজারের বেশি বই দিয়েছেন। খরচ হয়েছে ৩০ লাখ টাকার মতো।  কিছুদিন আগে তাঁকে ‘পাঠাগার বন্ধু’ সম্মাননা দিয়েছে জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ।
আমি তো টাকা জমাই না, আনন্দ জমাই
বইয়ের মাধ্যমে মানুষকে আনন্দময় জগতের সন্ধান দেন কাজী এমদাদুল হক খোকন।
ভদ্রলোকের পরনে প্রিন্টের ফুলহাতা জামার ওপর কালো সোয়েটার আর কালো প্যান্ট। চোখে চশমা। হাতে কয়েকটি বই। ধীর লয়ে হেঁটে বাংলা একাডেমির দিকে যাচ্ছিলেন।
ভঙ্গিটা চেনা। বছর দুয়েক আগে পরিচয় হয়েছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে। তাই সাহস করে ডাক দিলাম—‘এমদাদ ভাই, কোথায় যাচ্ছেন?’
সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। বুঝলাম, অনুমান ভুল হয়নি।
তিনি কাজী এমদাদুল হক খোকন। দেশের বইপ্রেমী মানুষ একনামে চেনে তাঁকে। তাঁর নামের আগে ‘বইবন্ধু’ উপাধিও যোগ করেন কেউ কেউ। গাঁটের পয়সা খরচ করে বছরের পর বছর যিনি বই বিলিয়ে যাচ্ছেন, উপাধিটা তাঁকেই মানায়।
কাছাকাছি যাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি নিয়ে বই বের হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে। অন্য কোথাও পেলাম না। তাই বাংলা একাডেমিতে যাচ্ছি। রংপুরের বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারে পাঠাতে হবে বইগুলো।’
এর মধ্যে বেজে উঠল এমদাদুল হকের মোবাইল ফোন।
রিসিভ করে বললেন, ‘ঠিকানা দেন। আশা করি, কাল পেয়ে যাবেন।’ ফোন রেখে বললেন, ‘পঞ্চগড়ের স্বপ্নসিঁড়ি গ্রামীণ লাইব্রেরি থেকে একজন ফোন করল। বইয়ের জন্য। সেখানে ৬২টি বই পাঠিয়েছি গতকাল।’
বাংলা একাডেমি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাবাজারসহ বইয়ের জন্য পরিচিত জায়গাগুলোতে প্রায়ই ঢু মারেন কাজী এমদাদুল হক খোকন। দেশের বিভিন্ন পাঠাগারের পরিচালকরা নিয়মিতই বই চেয়ে ফোন করেন তাঁকে। চাহিদামতো সেগুলো পাঠিয়ে দেন কাজী এমদাদুল হক খোকন। কাজটি করেন একেবারেই মনের আনন্দে। এভাবে এ পর্যন্ত দেশের ৫১৬টি পাঠাগারে পাঠিয়েছেন প্রায় ৩০ হাজারের বেশি বই। এতে তাঁর খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকার বেশি।
কেন বই বিলান?
‘মনের আনন্দে।’ সংক্ষেপে জবাব দিলেন এমদাদ। পড়ার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলার জন্য পাঠাগারগুলোকে বই উপহার দেন। পাঠকরা যে বই আবদার করে, সে বই-ই জোগাড় করে দেন। তবে এর পেছনে তাঁর বাবার একটি বড় ভূমিকা আছে। বাবার একটি উপদেশ সব সময় মেনে চলার চেষ্টা করেন। সে কথা স্মরণ করতে গিয়ে এমদাদ বললেন, “বাবা ছিলেন খুব শৌখিন মানুষ। তিনি বলেছেন, ‘বাজান, জানে রে কষ্ট দিয়া পয়সা জমাবি না। মনে যা চাইব তা-ই করবি।’ বই পেয়ে পাঠাগার প্রাণ ফিরে পেলে আমার আনন্দ লাগে। তাই বই বিলিয়ে যাই।”
এমদাদ আরো বললেন, ‘মোবাইলে আসক্তির ফলে কিশোর-তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে। তাদের বইমুখী করে ইতিবাচক ধারায় ফেরানো যাবে। কিন্তু অনেক পাঠাগারেই ভালো বই নেই। সাধ্যমতো বই পাঠিয়ে দিই। ভালো বই পেলে লোকজন পাঠে আগ্রহী হয়। স্ত্রীও আমাকে সহযোগিতা করে।’ এমদাদের স্ত্রী হাসিনা মমতাজ বললেন, “লোকে উনাকে ‘ভালো’ বলে। শুনতেও খুব ভালো লাগে।”
২০১৮ সাল থেকে শুরু
এর আগে পরিচিতজনদের বই দিয়েছেন। তবে মোটাদাগে বই বিলানোর শুরুটা ২০১৮ সাল থেকে। সেবার তপনকান্তি ধর নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এমদাদুল হকের। এমদাদ বইপড়ুয়া জেনে তপন বলেছিলেন, ‘গ্রামে আমরা একটি পাঠাগার করেছি, কিন্তু ভালো বইপত্র নেই।’ শুনে এমদাদ বললেন, ‘আমার কাছে অনেক বই আছে। আপনাকে কিছু দেব।’ কিছুদিন পর মৌলভীবাজারের সেই চুনগড় পাঠাগারে ছয় শতাধিক বই নিয়ে হাজির এমদাদ। দেখে তপনের আনন্দ যেন আর ধরে না।
পরের বছর একদিন ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখলেন—ময়মনসিংহের ত্রিশালে চালু হবে রানীগঞ্জ পাঠাগার। লোকজনের কাছে বই চাইছে সংশ্লিষ্ট তরুণরা। পরে মোবাইল নম্বর জোগাড় করে পাঠাগারের সভাপতি রোবায়েত হোসেনের সঙ্গে কথা বললেন। একদিন ৫২০টি বই নিয়ে সেই পাঠাগারে হাজির হলেন এমদাদ। নগদ দিলেন ১০ হাজার টাকা। স্টেশন লাইব্রেরি নামে আরেকটি পাঠাগারকে দিলেন ১০০টি বই। একসঙ্গে এতগুলো বই পেয়ে দারুণ আনন্দিত রানীগঞ্জ পাঠাগারের সদস্যরা। তাঁরা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ধন্যবাদ জানালেন এমদাদকে। সেই পোস্টের সূত্রেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেকেই বই চাইতে থাকল এমদাদের কাছে।
এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে ফেসবুকে কিংবা মোবাইলে এমদাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বইপ্রেমী তরুণ-তরুণীরা। সবার একটিই আবদার—বই চাই। এমদাদ পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা, পাঠক, আসবাব ইত্যাদির খোঁজ নেন। পরে চাহিদামতো বই কিনে বাসায় এনে কার্টনে ভরেন। প্রথম প্রথম নিজে গিয়ে দিয়ে আসতেন। এখন শরীর সায় দেয় না। তাই কুরিয়ারের মাধ্যমে সেগুলো পৌঁছে দেন দেশের আনাচকানাচে। এভাবে এ পর্যন্ত দেশের ৫১৬টি পাঠাগারকে বই দিয়েছেন।
ময়মনসিংহের হারুন পাঠাগারে ১৮ বার বই পাঠিয়েছেন এমদাদ
যে ধরনের বই পাঠান
এমদাদ মূলত বই কেনেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলা একাডেমি, আজিজ মার্কেট কিংবা বাংলাবাজার থেকে। দীর্ঘদিন ধরে যেতে যেতে প্রকাশকদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে তাঁর। বললেন, ‘প্রকাশনীগুলোও এখন আমাকে অন্যদের চেয়ে বেশি ছাড় দেয়।’ গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ, রম্য ইত্যাদি বই বিলান। ঐতিহ্য থেকে ৩০ খণ্ডে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ দিয়েছেন চারটি পাঠাগারকে, নজরুল ইনস্টিটিউটের ‘নজরুল রচনাবলী’ দিয়েছেন ৩০টি পাঠাগারকে। ‘সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাসমগ্র’ দিয়েছেন ২৫টি পাঠাগারকে, এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘বাংলাপিডিয়া’ দিয়েছেন ১৫টি পাঠাগারকে। এ ছাড়া ‘শরৎ রচনাবলী’, ‘জীবনানন্দ দাশ রচনাসমগ্র’, ‘হুমায়ূন আহমেদ রচনা সমগ্র’সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বই দিয়েছেন। কোনো কোনো পাঠাগারে ২০ বারের বেশি বই পাঠিয়েছেন।
ময়মনসিংহের রানীগঞ্জ পাঠাগারের বর্তমান সভাপতি তানভীর আহমেদ বললেন, ‘আমাদের পাঠাগার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এমদাদ স্যার বই প্রদানসহ সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছেন। উনার মতো মানুষ এখন বিরল।’
কুড়িগ্রামের উলিপুরের সাতভিটা গ্রন্থনীড়ের প্রতিষ্ঠাতা জয়নাল আবেদীন বললেন, ‘আমাদের পাঠাগারে কয়েক দফায় বই পাঠিয়েছেন এমদাদ স্যার।’ গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের সুলতানা রাজিয়া পাঠাগারের সভাপতি মো. বেলাল বললেন, ‘এমদাদ স্যারের মতো পাঠাগারকে ভালোবাসেন এমন মানুষ কম।’
অর্থের উৎস কী?
২০১৫ সালে অবসরে গেছেন এমদাদ। অবসরের সময় এককালীন কয়েক লাখ টাকা পেয়েছিলেন। তা ছাড়া তাঁর স্ত্রীও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। হাসিমুখে এমদাদ বললেন, ‘আমি তো টাকা জমাই না, আনন্দ জমাই। আমরা খুব সাধারণ জীবন যাপন করি। নিজের আর স্ত্রীর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া অর্থ মিলে খেয়ে-পরে ভালোই চলে যায় আমাদের। বাকি টাকা ব্যয় করি বই কেনার কাজে।’
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বেশ কয়েকবার সম্মাননা পেয়েছেন প্রচারবিমুখ এ মানুষটি। রাজশাহীর বোয়ালিয়ায় জননী গ্রন্থাগার ও সাংস্কৃতিক সংস্থা এবং গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের সুলতানা রাজিয়া পাঠাগারে এমদাদের নামে কর্নার আছে। ২০২২ সালে টাঙ্গাইলে অনুষ্ঠিত পাঠাগার সম্মেলনে সম্মাননা জানানো হয়েছে তাঁকে। এর আগে পাবনার নাজিরপুরে জনকল্যাণ পাঠাগার থেকেও সম্মাননা পেয়েছেন।
মানুষকে আনন্দময় জগতের খোঁজ দিতে চান
এমদাদুল হকের বয়স এখন ৬৮ বছর। এই বয়সে টানা পড়তে গেলে চোখে সমস্যা হয়। তবে যে বই ভালো লাগে, চেষ্টা করেন সময় নিয়ে হলেও পড়ে নিতে। এমদাদের এখন শুধুই অবসর। দেশের কোনো প্রান্ত থেকে চাহিদা এলেই বই কেনেন। যত দিন বাঁচেন কাজটি চালিয়ে যেতে চান। মানুষকে দিতে চান আনন্দময় এক জগতের খোঁজ। বললেন, ‘ছাত্রাবস্থায় খুব একটা আউট বই পড়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা যেন সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, তাই বই বিলিয়ে যাচ্ছি।’
একনজরে
কাজী এমদাদুল হক খোকন
জন্ম ১৯৫৬ সালে, ময়মনসিংহে। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব-কৈশোর কেটেছে ময়মনসিংহে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। বিএ পাস করেন শরীয়তপুরের ডামুড্যা কলেজ থেকে। ১৯৮০ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন স্টেনোগ্রাফার হিসেবে। অবসরে যান ২০১৫ সালে। এখন থাকেন ঢাকার মিরপুরে। ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..