ছবিটা প্রতিকী তবে অর্থবহ। আমাদের সমাজে একটা কালচার আছে, আমরা সমাজে সংগঠিত যেকোন অপরাধকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভংগিতে দেখতে পছন্দ করি। যেকোন অপরাধীর যদি কোন দলের কোন রাজনৈতিক নেতার সাথে সামান্যতম পরিচয় বা চলাফেরা থাকে তাকে ওই দলের কর্মি হিসেবে উল্লেখ করে আমাদের মিডিয়িগুলো। এতে মিডিয়ার কাটতি ও ভিউ বাড়ে। আলোচনা, সমালোচনা, আলোড়ন, বিতর্ক বেশী তৈরী হয় এবং ওই নিউজ ও মিডিয়া ভাইরাল হয়।
অরাজনৈতিক লোকের অপরাধ অতোটা ভাইরাল হয়না। এজন্যই কোন অপরাধ পেলেই আমাদের মিডিয়াগুলো সবার আগে অপরাধীর রাজনৈতিক কানেকশন খুঁজে। এতে সমাজে আলোড়ন বেশী তৈরী হয় ঠিকি কিন্তু ব্যাক্তি দোষ গিয়ে পড়ে কোন দলের উপর। তারপর রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের মাঝে হারিয়ে যায় ওই অপরাধীর অপরাধের কারন ও মনস্তত্ত্ব। বিশ্লেষন ওখানেই ভিন্ন দিকে মোড় নেয় এবং সমাধান হারিয়ে যায়। একারনে অপরাধীরাও রাজনৈতিক দলগুলোতে অপরাধ করার নিমিত্তেই আশ্রয় নেয়।
যেই রাজনৈতিক কালচার আমাদের তৈরী হয়েছে তাতে রাজনৈতিক দলগুলোতেও যে অপরাধী প্রডিউস হয়না তা না। তবে রাজনীতি করার ইচ্ছা নিয়ে যারা আসে তাদের অপরাধ রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তায় থাকে সীমিত। কিন্তু যারা স্বভাবগতো অপরাধী বা অবাধ অপরাধ করার লাইসেন্সের জন্যই দলগুলোতে যায় তাদের অপরাধ যেমন থাকে বেপরোয়া তেমনি তারাও শুধুমাত্র রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয় এবং সর্বপ্রথম রাজনৈতিক বলির শিকারও হয় তারা।
এই লেখার উদ্দেশ্যও সেই রাজনৈতিক বলির পুতুলদের নিয়েই। আমরা সাধারনত আমাদের দেশের অপরাধী চক্রকে বড়ো দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লোক হিসেবে দেখে বা চিহ্নিত করে অভ্যস্ত। যেখানে যা কিছু ঘটুক এই প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর উপরেই চাপিয়ে দেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়তো তা সত্যিও। তবে সম্প্রতি গতো কয়মাসে লোকচক্ষুর আড়ালে আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর মোড়কের বাইরেও একেবারেই ব্র্যান্ড নিউ অপরাধী চক্র গড়ে উঠছে। গড়ে উঠছে না বলে গড়ে তোলা হচ্ছে বলা অধিকতর সঠিক হবে।
এই ব্র্যান্ড নিউ যারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এদের অধিকাংশেরই বয়স ১৬/১৭ থেকে ২৮/৩০ এবং এদের অতীতেও তেমন অপরাধের রেকর্ড নাই। যেমন দেশের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ছে বহু সাধারন শিক্ষার্থী যাদের রাজনৈতিক অতীত নাই। বিভিন্ন অফিসগুলোতে সম্প্রতি চাঁদাবাজিতে যাদের নাম আসছে এদেরও রাজনৈতিক অতীত নাই। গতো দুই মাসে যৌথবাহীনির অভিযানে অনেক তরুন নতুন ডাকাত ও চাঁদাবাজ গ্রেফতার হয়েছে যারা সবাই বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির রানিং শিক্ষার্থী এবং যাদের অতীত রাজনীতি ও অপরাধের রেকর্ড নাই।
সচিবালয়ে ইদানিং যেসব খুব অল্প বয়স্ক তরুনদের বিভিন্ন তদবির নিয়ে দিনরাত ঘুরতে দেখা যায় এরাও কয়েকমাস আগ পর্যন্তও স্রেফ শিক্ষার্থী ছিলো। ক্যাম্পাসগুলোতে ইদানিং যাদের দেখবেন পড়াশুনা বাদ দিয়ে লাঠি হাতে নিয়ে ঘুরছে, নানা নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে, ছাত্রদল-ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হতো তারাও ঠিক তাই তাই করছে শিক্ষার্থী অথবা ছাত্র-জনতার মোড়কে এরাও কয়দিন আগে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ দেখে পাশ কাটিয়ে যেতো। পাড়ায় পাড়ায় খেয়াল করলে দেখবেন ফুটপাতে চাঁদা তুলছে একেবারেই নতুন নতুন মুখ। রাজনৈতিক দলগুলো তুলছেনা তা না তবে একেবারেই ব্র্যান্ড নিউ কিছু মুখও যোগ হয়েছে।
এই একেবারেই তরুন যে নতুন অপরাধী চক্র গড়ে উঠছে এরাও নতুন কিছু লোকের ছত্র-ছায়ায়ই গড়ে উঠছে। এরা বয়সে খুবই তরুন ও রাজনৈতিক অনভিজ্ঞ হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচার এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারনা কম রাখে। তারা যে নতুন রাজনৈতিক লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে নতুন কারো দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে এটা অনেকেই বুঝতে পারেনা। তরুন বয়সের প্রচুর ফ্যান্টাসি ও মহল্লায় বা মেয়েদের কাছে হিরো হওয়ার প্রবল প্রবনতা এদের মধ্যে কাজ করছে। বাংলাদেশের বর্তমানে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বড়ো দুই রাজনৈতিক দল থেকে ছিটকে পড়া কিছু সুযোগ সন্ধানি ব্যাক্তির দ্বারা এরা যাচ্ছেতাই ব্যবহার হচ্ছে।
আমি ঢাকা শহরের ৫/৬ টা এলাকার বেশ কিছু তরুনের বর্তমান কর্মকান্ড বিশ্লেষন ও অনুসন্ধান করে দেখেছি। এরা বর্তমানে শুধু শিক্ষার্থী অথবা ছাত্র-জনতা হিসেবে পরিচয় পেলেও এরা মূলত কিছু তৃতীয় শ্রেনীর রাজনৈতিক লোক যারা বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোয় সুযোগ পায়নি কিন্তু এখন সুযোগে অন্য দলের হয়ে অরাজনৈতিক ছদ্মবেশে লাইম-লাইটে আসার চেস্টা করছে এদের দ্বারা বিভিন্ন এলাকার কল্যান সমিতি, বাজার, ব্যবসায়িক সমিতি, বাজার সমিতি ইত্যাদি দখলের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আর এই নতুন তরুনরা যারা সাধারনত এলাকার সবচেয়ে গোবেচারা টাইপ ছিলো এবং তাদের অল্প বয়সের জীবনে একটা রাজনৈতিক সরকার ছাড়া আর কোন সরকার দেখেনি তারা খুব সহজেই রাজনৈতিক ব্রেনওয়াশে ভেসে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে কিছু প্রশাসনের মানুষের সাথে ও ছদ্মবেশী রাজনৈতিক অসাধু সুবিধাবাদীদের সাথে ছবি তুলেই নিজেকে মনে মনে হিরো ভাবতে শুরু করেছে। এদের সবার মধ্যে আরো একটা জিনিস কমন তা হচ্ছে, সবারই মোবাইলে দু/একজন সমন্বয়কের সাথে একটা দুটো ছবি আছে। এই নতুন তরুনদেরকে অরাজনৈতিক খোলশে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর বিপক্ষে গোপনে অন্য রাজনৈতিক দলের স্ট্যাবলিশমেন্টে ব্যবহার করা হচ্ছে।
যেমন এদেরকে দিয়ে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আন্দোলন করাচ্ছে আড়াল থেকে বড়ো দুই রাজনৈতিক দল বিরোধী অন্য রাজনৈতিক দল। পাড়া মহল্লায় এদেরকে দিয়ে বড়ো দুই রাজনৈতিক দলকে কাউন্টার দেওয়ার চেস্টা করা হচ্ছে। যারা আড়াল থেকে এদেরকে ব্যবহার করছে তারা চাচ্ছে এরা সর্বত্র রাজনৈতিকভাবে কালার হোক এবং এদের রাজনৈতিক শত্রু তৈরী হোক। তাহলেই এরা দীর্ঘদিন কুশিলবদের আকড়ে ধরে থাকবে। এজন্যই এদের অনেক অন্যায় ও অবৈধভাবে খরচের টাকা জোগাড়ে উৎসাহ ও প্রশ্রয় দিচ্ছে।
কিন্তু রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, ইতিহাসের জ্ঞানের অভাব ও অল্প বয়সের ফ্যান্টাসি এবং হিরোইজমের লোভে এরা অনেকেই বুঝতেও পারছে না এরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, বড়ো দুই রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে মোটিভেশনের আড়ালে এদেরকে প্রচন্ড বাংলাদেশ ও স্বাধীনতা বিরোধী করে তৈরী করা হচ্ছে এবং পাড়া মহল্লায় বিশাল শক্তির ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ প্রতিপক্ষ হিসেবে এরা চিহ্নিত হচ্ছে। এদের পিছনের শক্তিও এদেরকে নানা প্রলোভন ও অবাস্তব আশায় ভুলিয়ে রাখছে।
কিন্তু বাংলাদেশের মাঠের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও এদের পেছনের নতুন লোকদেরও সেই একই দূর্নীতি এবং উগ্র চরম রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক খুবই রিস্কি কর্মকান্ড নিশ্চিৎভাবেই এই নতুন তরুনদের জীবন নিটক ভবিষ্যতে খুবই হুমকির মধ্যে ফেলে দিবে। তাদের স্থানীয় পেট্রোনাইজাররা নিজেদের অবস্থান তৈরী করে বড়ো রাজনৈতিক দলগুলোতে ভীড়ে যাবে এবং কেন্দ্রীয় মুখগুলো লাপাত্তা হয়ে যাবে। এই নতুন তরুনরা সবচেয়ে সহজ রাজনৈতিক টার্গেটে পরিনত হবে। পরিস্থিতি খুব দ্রুত সেদিকেই যাচ্ছে।
Leave a Reply