মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে সন্ধ্যায়। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের সবাই এবং একান্ত শিষ্য’রা তার চারপাশ ঘিরে আছেন।
কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। প্রধান কারারক্ষী এসে শেষ বিদায় নিয়ে গেলেন। তার চোখেও অশ্রু টলমল করছে। হায়, কি অদ্ভুত শাস্তি! যে মরবে সে ধীরস্থির, শান্ত। আর যে মারবে তার চোখে জল। কারাগার প্রধান বললেন, ‘এথেন্সের হে মহান সন্তান, আপনি আমায় অভিশাপ দিবেন না। আমি দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। এতবছর কারাগারে কাজ করেছি, আপনার মতো সাহসী, সৎ এবং জ্ঞানী কাউকে আমি দেখিনি।
মৃত্যুর ঠিক আগে সক্রেটিস তার পরিবারের নারী ও শিশুদের চলে যেতে বললেন। সুন্দর পোষাক পরলেন তিনি। শিষ্যরা সবাই কাঁদছে কিন্তু সক্রেটিস যেনো বেপরোয়া। মৃত্যুতে কি কিছুই যায়-আসেনা তার? মৃত্যুদন্ডটা চাইলেই তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো- দেবতাদের প্রতি ভিন্নমত প্রকাশ, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র এবং তরুণদের বিপথগামী হতে উৎসাহ প্রদান। নিয়ম অনুযায়ী খোলা মাঠে তার বিচার বসেছিলো। বিচারক ছিলেন সমাজের ৫০০ জন জ্ঞানী মানুষ। এদের অনেকেই ছিলেন গ্রীসের রাজার একান্ত অনুগত। সক্রেটিসের মেধা এবং বিশেষতঃ তরুণদের কাছে তার জনপ্রিয়তায় জ্বালা ছিলো তাদের। সক্রেটিসকে খতম করার এমন সুযোগ তারা ছাড়বে কেন ? তবুও হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন সক্রেটিস। কিন্তু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বিচারকদের নিয়ে উপহাস করতে ভুললেন না। ফলাফল ‘হ্যামলক বিষপানে মৃত্যু’।
মৃত্যুর আগে একমাস কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি। নিয়ম ছিলো এমন। এই একমাসে কারারক্ষীরাও তার জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে গেলো। তারা তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে চাইলো। সক্রেটিস বিনয়ের সাথে না করে দিলেন। বললেন ”আজ পালিয়ে গেলে ইতিহাস আমায় কাপুরুষ ভাববে”। তিনি পৌরুষের সাথে মৃত্যুকে অপমানের জীবনের চাইতে শ্রেষ্ঠ বলে মানলেন।
ঐ সন্ধ্যায় প্রধান কারারক্ষী চলে যাওয়ার পর জল্লাদ এলো পেয়ালা হাতে। পেয়ালা ভর্তি হ্যামলকের বিষ। সক্রেটিস জল্লাদকে বললেন ”কি করতে হবে আমায় বলে দাও। তুমি আমার চাইতে ভালো জানো”। জল্লাদ বললো ”পেয়ালার পুরোটা বিষ পান করতে হবে, একফোঁটাও নষ্ট করা যাবেনা”। সক্রেটিস বললেন ”তবে তাই হোক”। তিক্ত বিষের পুরো পেয়ালা তিনি পানির মতো করে পান করে ফেললেন। চারপাশে বসে থাকা শিষ্যরা চিৎকার করে কাঁদছেন। এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ। তখন জল্লাদ আরও কঠোর নির্দেশটি দিলো। বললো ”নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে এখন কিছুক্ষণ পায়চারী করতে হবে, যাতে বিষের প্রভাব পুরোটা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পরতে পারে”। হায় হায় করে উঠলেন সবাই। শুধু ম্লান হাসলেন সক্রেটিস। বললেন ” আজীবন আইন মেনেছি, মৃত্যুতে আইন ভাঙবো কেন” ? দূর্বল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটলেন কিছুক্ষণ, যতক্ষণ তার শক্তিতে কুলোয়। এরপর বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। শিষ্যদের বললেন ”তোমরা উচ্চস্বরে কেঁদোনা, আমায় শান্তিতে মরতে দাও”। জল্লাদের পাষাণ মনেও তখন শ্রদ্ধার ভাব, বিনয়ে আর লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো সে। চাদর দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলেন সক্রেটিস। একবার চাদরটা সরালেন। একজন শিষ্যকে ডেকে বললেন ”প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটা মুরগী ধার করেছিলাম আমি, ওটা ফেরত দিয়ে দিও”।
এই ছিলো তার শেষ কথা। ক্ষনিক পরেই অনিশ্চিত যাত্রায় চলে গেলেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিস। তার শিষ্যদের মাঝে সেরা ছিলেন প্লেটো। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এই ঘটনাগুলো প্লেটো লিখে রেখে গেছেন। প্লেটোর শিষ্য ছিলেন মহাজ্ঞানী এ্যারিষ্টটল, সর্বকালের জ্ঞানী মানুষের উপরের সারির একজন। মহাবীর আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের নাম আমরা সবাই জানি। এই বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের শিক্ষক ছিলেন এ্যারিষ্টটল।
প্রহসনের বিচারে সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছে ঠিকই কিন্তু মৃত্যু তাকে মারতে পারেনি। শিষ্যদের মাঝে জ্ঞানের আলো দিয়ে বেঁচে রইবেন তিনি অনন্তকাল। সত্য প্রকাশে যারাই লড়বে, একাত্তুর বছর বয়সে মৃত সক্রেটিস(Socrates) তাদের কাছে উৎসাহের এক নাম হয়েই রইবে…।
এই চিত্রকর্মটির নাম “সক্রেটিসের মৃত্যু”। আজ থেকে প্রায় দু’শ তিরিশ বছর আগে (খ্রি. ১৭৮৭) ফ্রান্সের শিল্পী জাঁক-লুই ডেভিড এই ছবিটা আঁকেন। ছবিটার গল্পটা সবারই জানা। সক্রেটিসের সামনে মেলে ধরা হয়েছে হেমলক বিষের পাত্র, সক্রেটিস সেটা নির্দ্বিধায় পান করছেন। ছবির ডান দিকে তার শিষ্যরা শোকে, ক্ষোভে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে। সক্রেটিসের বামে যে লোকটি হেমলকের পাত্র এগিয়ে দিচ্ছে, তার নিজের মুখও লজ্জায় ঢাকা, এমন জ্ঞানী একজন মানুষের মৃত্যু তার মাধ্যমে হচ্ছে, হয়তো সেই কারণেই।
Leave a Reply