1. banglamailnews72@gmail.com : banglamailnews : Zakir Khan
শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫, ০১:৫৩ অপরাহ্ন

মাসরুর আরেফিন বনাম হাসান আজিজুল হক বিতর্ক এবং আমার নিজের নাক ………………………….ফরিদ কবির

  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০২১
  • ৫২৮ বার
এই বিতর্কে নিজের নাকটা না গলালেই হতো। কিন্তু গলাতে ইচ্ছে করলো। যদিও জানি, অনেকেই আমার এই নাক গলানো অপছন্দ করবেন।
বলা দরকার, এ বইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক একটাই, বইটা সম্প্রতি আমি সংগ্রহ করেছি। তবে এই বইয়ের প্রচারণার বিষয়টা অধিকাংশ কবি-লেখক যেভাবে দেখছেন, সেভাবে আমি দেখছি না বলেই নিজের ‘নোংরা’ নাকটা গলাতে হচ্ছে!
মাসরুর আরেফিনের ‘আগস্ট আবছায়া’র দুটো কপি আমি কিনেছি। একটা নিজের জন্য, অন্যটি আমার অনুজপ্রতিম কবি শোয়েব সর্বনামের জন্য। সংগ্রহের পরপরই ঢাকার বাইরে চলে যাওয়ায় বইটি আমার এখনো পড়া হয়নি। কোনো বই পড়ে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া আমার কখনো লেখা হয় না। কিন্তু আমি স্থির করেছি, এ বইটি নিয়ে আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া আমি লিখবো। যারা আমাকে চেনেন, তারা জানেন, মিথ্যে প্রশংসা বা নিন্দা কোনোটাই আমি করি না। বইটা ভালো লাগলে ভালো বলবো, মন্দ লাগলে মন্দই বলবো।
অনেকে জানেন, লেখক বা কবি হিসেবে আমি যা-ই হই না কেন, নিজেকে আমি একজন অগ্রসর পাঠক বলেই মনে করি। আমার ধারণা, ভালো কবিতা বা ভালো রচনা আমি সনাক্ত করতে জানি। সেটা আমার এমনি এমনি হয়নি। জীবনে অজস্র ভালো বই আমি পড়েছি। ফলে যে কোনো লেখার মান আমি মোটামুটি বুঝতে পারি।
বাংলাদেশের পাঠকরা যখন শহিদুল জহির পড়েই দেখেননি, তখন এ বই পড়ে আমিই অনেককে তার ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ পড়তে প্ররোচিত করেছি। পঞ্চাশের দশক থেকে লিখতে শুরু করলেও কবি উৎপল কুমার বসুর কথা এদেশে কেউ জানতেন না। এমনকি সত্তুরের দশক থেকে লিখলেও আমাদের ‘সত্তুরের’ কবিরাও জয় বা মৃদুলের নাম জানতেন না। তাদের কবিতা পড়তেও আমি আশির দশকেই অনেককে উদ্বুদ্ধ করেছি। তাদের নাম বাংলাদেশের পাঠকরা জেনেছেন অনেকটা আমার সূত্রেই।
বলতে চাইছি, আমাদের দেশে ভালো পাঠকের খুবই অভাব। এমন পাঠক সত্যিই কম, যার সার্টিফিকেট পেলে সে বই পড়ার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মাবে। কারণ আমাদের বেশিরভাগ পাঠকই উদ্বুদ্ধ হন প্রচার-প্রচারণা দেখে। নতুবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে। কিংবা বিশেষ স্বার্থে। নিজে থেকে সৎ সাহিত্যিক উদ্দেশ্যে কোনো লেখার মান বিচার করতে পারেন এবং তার উল্লেখ করতে পারেন, এমন পাঠক নেই বললেই চলে।
ভালো পাঠকের কাতারে পড়েন এমন কবি-লেখকদের সংখ্যা খুবই হাতে গোনা, সেখানে মাসরুরকে আমার একজন ভালো পাঠক বলেই মনে হয়েছে। লেখক হিসেবে তিনি কেমন তার বিচার করার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু তিনি যে অনুবাদক হিসেবেও দারুণ তার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন কাফকা ও হোমারসহ অনেক বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদের মাধ্যমে। আমি মনে করি, একই সঙ্গে তিনি এও জানিয়ে দিয়েছেন, কর্পোরেট চাকরির বিপুল ব্যস্ততা, ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই ও সংগ্রামও তাকে সাহিত্য থেকে, পাঠ থেকে, অনুবাদকর্ম থেকে নিরস্ত করতে পারেনি। বাংলাদেশের কবি-লেখকদের কতো অংশ নিয়মিত বই পড়েন সেটার আন্দাজ আমার একেবারে নেই, তা নয়। মাসরুরের সঙ্গে সামান্য আলাপের সূত্রে তার পড়াশোনার যে ব্যাপ্তিটুকু আমার নজরে পড়েছে, তাতে তাকে কেবল চাকরিবাকরির কারণে ‘কর্পোরেট’ বলে গাল দেয়াটাকে চরম নিষ্ঠুরতা বলেই মনে হচ্ছে আমার।
নব্বই দশকে আলাপ-পরিচয় হলেও দু’-চারবারই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। সেটুকু দেখা বা আলাপেই আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে চাকরির বাইরে পড়াশোনা নিয়ে থাকতেই তিনি পছন্দ করেন। সঙ্গে বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদও। আর, তার অনুবাদের পরিমাণও নেহাৎ কম নয়।
মাসরুর আরেফিনের উপন্যাসটি নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই দেখছি, ফেসবুক বেশ গরম। তার বইয়ের ফ্ল্যাপে হাসান আজিজুল হকের একটি মন্তব্য নিয়েই মূলত বিতর্কের শুরু।
আমাদের দেশে কিছু লেখক-কবি আছেন যারা তাদের লেখার জন্য অন্য লেখকের সার্টিফিকেট নিতে পছন্দ করেন। একইভাবে, কিছু লেখক-কবি আছেন যারা সার্টিফিকেট দিতে পছন্দ করেন। দু’ পক্ষই এমন সার্টিফিকেট দিতে পেরে এবং নিতে পেরে বিমলানন্দ লাভ করেন।
অনেকে করেন, সে ঠিক আছে। মাসরুরের কেন এমন একটি সার্টিফিকেটের দরকার হলো, সেটা ভেবে বরং আমি খুবই বিস্মিত হচ্ছি। কারণ তার সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে আমার মনে হয়েছে, তিনি নিজের রচনা বিষয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তাহলে এমন একটি সার্টিফিকেটের জন্য তিনি কেন আরেকজন লেখকের দ্বারস্থ হলেন? এর মনস্তাত্ত্বিক কারণ আমার জানা নেই। কিন্তু, বিষয়টাতে আর যা-ই হোক, কোনো অপরাধ আমি দেখতে পাই না। এমনকি, হাসান আজিজুল হকের নামে যে মন্তব্যটি তার বইয়ের ফ্ল্যাপে ব্যবহৃত হয়েছে, তাতেও তার কোনো অন্যায় আমি দেখি না।
মাসরুরের অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কেন এতো হৈচৈ, সেটাও আমার কাছে স্পষ্ট না। মানে, অন্য এক বা একাধিক লেখককে তার পাণ্ডুলিপি পড়ে একটা রিভিউ লিখে দেয়ার জন্য তিনি সম্মানী দিতে চেয়েছেন, তাতে এমন কী গুনাহ হলো? তিনি নিজের টাকায় বইয়ের একটি পোস্টার ছেপেছেন, তাতেই বা অন্যায়টা কী হলো? কেউ আমাকে সাড়ে তিন শো পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি পড়ে এমন একটা সার্টিফিকেট দিতে বললে আমি তো এক লক্ষ টাকা চাইবো!
এটা তো ঠিক, বাংলাদেশে যাদের বইয়ের প্রচার-প্রচারণা বেশি, তাদেরই বই বেশি বিক্রি হয়। সংবাদপত্রে যাদের সচিত্র রঙিন বিজ্ঞাপন প্রতিদিন দেখা যায়, সেখানে আসল লেখকরা প্রায় সব সময়েই গড়হাজির। যেসব লেখকের বিজ্ঞাপন সেখানে ছাপা হয়, তার অধিকাংশ হয় লেখকদের টাকাতেই। তাতেও অন্যায়ের কিছু দেখি না। কিন্তু এটাও সত্যি, আমাদের বেকুব পাঠকরা সেই রঙিন বিজ্ঞাপনেই ভোলেন!
আমি অনেক কবি-লেখকের নাম বলতে পারবো, যাদের বই প্রচারণার কারণে অনেক খ্যাতি পেয়েছে। আবার প্রচারণার অভাবেই অনেক লেখক-কবি রয়ে গেছেন আড়ালেই। যেমনটা হয়েছিলো শহিদুল জহিরের বেলাতেও। আপনি বলবেন, তাতে কী! তার বই যে মহার্ঘ, তা কি পরে স্পষ্ট হয়নি?
আমি বলবো, হয়েছে। কিন্তু তাতে সেই লেখক কী পেলেন? জীবিতকালে তিনি তার অবস্থানটাই ঠিকভাবে জেনে যেতে পারেননি! জীবনানন্দের মতো তাকেও মরতে হয়েছে অনেকটা অপরিচিত লেখকের তকমা নিয়েই। কই, বেঁচে থাকতে কোনো পুরস্কারওয়ালাকে তো দেখলাম না, তার সাহিত্যের স্বীকৃতি দিতে? এই হাসান ভাইরাই তো থাকেন বিভিন্ন পুরস্কার কমিটির বিচারক পদে! তিনি বেঁচে থাকতে কতোগুলি কমিটির হয়ে আজেবাজে লেখকদের নাম তিনি অনুমোদন করেছেন, তার একটা লিস্টি দিলেই তার সাহিত্যিক সততার বিচার করা সহজ হবে।
তা ছাড়া, প্রথমা নামের প্রকাশনীটির সঙ্গে একটি শীর্ষ দৈনিক জড়িত থাকায় সেখান থেকে প্রকাশিত শেখ আবদুল হাকিমদের বইও যেভাবে প্রচার পায়, তার ১ শতাংশও পায় না আর কোনো প্রকাশনীর ভালো মানের বইও। ফলে, অনেক ভালো বই থেকে যায় অন্ধকারেই। আর, প্রথমার খারাপস্য খারাপ বইটিও এক মেলায় দু’-চার সংস্করণ বের হতে দেখি! যদিও জানি, বই বেশি বেচাকেনার ওপর বইয়ের মান নির্ভর করে না কখনো। কিন্তু আমি সব সময়ই প্রত্যাশা করি, ভালো বই বেশি প্রচার পাক, সেটা বেশি লোকে পড়ুক।
আমার সামর্থ্য থাকলে আমিও প্রতিদিন বিভিন্ন দৈনিকে ‘আমার গল্প’র রঙিন বিজ্ঞাপন ছাপাতাম। কয়েক লক্ষ পোস্টারও। সেটা করতে পারলে আমার সে বইটির এতোদিনে হাজার হাজার কপি বিক্রি হতে পারতো! কিন্তু তা হয়নি। এটা একান্তই আমার সমস্যা। আমাদের প্রকাশকরা সাধারণত বই বের করে দিয়েই মনে করেন লেখকদেরকে ধন্য করে ফেলেছেন! তার প্রচার বা বিপণনের ব্যাপারে তারা অতোটা গরজ আর দেখান না।
এ অবস্থায় কোনো লেখক যখন তার বইয়ের প্রচারণা চালান, সেটাকে কিছুতেই আমার দোষের মনে হয় না। আমাদের মতো যাদের পয়সা নেই, ফেসবুকই তাদের ভরসা। আমরা কি নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন সেখানে সাধ্যমতো করি না? আমাদের অঢেল টাকা থাকলে, আমাদের অনেকেই বইয়ের বিজ্ঞাপনে টাকা খরচ করতে দ্বিধা করতেন না। আমাদের প্রচুর পাঠক থাকলে প্রকাশকরা হয়তো নিজেরাই বইয়ের প্রচারে অর্থ ব্যয় করতেন! আবার এও সত্যি, একটা কবিতার বইয়ের জন্য দৈনিকে বিজ্ঞাপন করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের দরকার তা কোনো প্রকাশকের পক্ষেই লাভজনক না। এমনকি সে বইটির দু’-এক হাজার কপি বিক্রি হলেও।
শেষ করি, সার্টিফিকেটের প্রসঙ্গ দিয়ে।
হাসান আজিজুল হক কেন, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ বেঁচে থাকলে, এবং তারা আমার ঘনিষ্ট থাকলে আমি তাদের সার্টিফিকেটের জন্যও হাত পাততাম না। সবচাইতে বড় কথা, হাসান আজিজুল হকের সার্টিফিকেটের কোনো দামই আমার কাছে নেই। কেবল হাসান ভাই কেন, বাংলাদেশের কোনো লেখকেরই সার্টিফিকেট নেয়ার কথা আমি ভাবতে পারি না। কারণ এমন অনেককেই তারা সার্টিফিকেট দিয়েছেন, যারা লেখক হিসেবেই পাতে দেয়ার মতো না। শামসুর রাহমানও মোহন রায়হানসহ এমন অনেককে সার্টিফিকেট বিলিয়েছেন যারা কখনোই কবি বা লেখক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আর, এটাও মনে রাখতে হবে যখনই কোনো ‘সার্টিফিকেট’ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, তখনই হাসান ভাই তার সার্টিফিকেট নাকচ করার চেষ্টা করেছেন। এর পরেও মাসরুর তার ওপর কেন নির্ভর করলেন, আল্লাই মালুম। আরো বিস্ময়ের, টেলিফোনে নেয়া মন্তব্য ‘ভেরিফাই’ না করেই কীভাবে তিনি বা প্রকাশক বইয়ের ফ্ল্যাপে ব্যবহার করলেন?
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, মাসরুর আরেফিন আসলে ঈর্ষার শিকার। আমরা যা হতে পারি না, আমরা যা করতে পারি না, তা আর কেউ হোক, তা আর কেউ করুক সেটা বাঙালিদের পক্ষে হজম করা একটু মুশকিলই।
আমি নিজে দরিদ্র মানুষ। কিন্তু কোনো লেখক বা কবি কিছুটা ধনী হলে আমরা ওঁৎ পেতে বসে থাকি, তাকে একেবারেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার জন্য। এই মানসিকতাটাই আমার পছন্দ না।
কাঁধে ঝোলা আর ছেঁড়া বা ময়লা পোশাক পরলেই তিনি বড় লেখক বা কবি?
সাহিত্যের মধ্যে বা কবিতার মধ্যে বাঁচা, আর সাহিত্যের ভাব বা কবিভাব নিয়ে বাঁচার মধ্যে তফাৎ কিন্তু যোজন যোজন দূরের!

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..