কবিরুল ও আমি যে বয়সে পৌঁছেছি তাকে প্রাজ্ঞ বয়স বলা যায়। পুরাকালে বাঙালির যে গড় বয়স ছিল তা বিচারে আনলে আমরা বহুকাল ধরেই একটি বোনাস জীবন যাপন করছি। ষাট পেরুলেই যে ধাক্কাটা এসে বুকে লাগে তা হলো তবে কি ফুরিয়ে এলো শখের জীবন? যে মৃত্যুভাবনা যৌবনে মনের আশেপাশে ভীড় জমাতে পারেনি তাই মূর্তিময় আতঙ্ক হয়ে উদিত হয় ভাবনাদিগন্তে। যৌবন ছিল সাম্রাজ্য বাড়ানোর এক কালপর্ব, মধ্যবয়স ছিল সে সাম্রাজ্য ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষার যুগ, আর এখন গুটিয়ে নেবার কাল। এ বয়সেই মানুষ সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে, শরীরে চড়ায় গৈরিকবেশ। দেহে ও মনে নামে তাঁবু গুটানোর বিষাদ। আমাদের সমুখে একমাত্র আশার আলো বাঙালির গড় বয়স আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতি। একদা আমরা সমুখপানে তাকিয়েছি, এখন আমরা পেছনে ফিরে তাকাই। ভবিষ্যতের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে অতীতকাল।
আমরা বসেছি ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের মিনাবাজারের দোতলার কফি ওয়ার্ল্ডে। আগে ছিল গুটিকয়, এখন ওই এলাকা জুড়ে রেস্টুরেন্ট আর রেস্টুরেন্ট। রঙিন নিয়নবাতিতে জ্বলজ্বলে তাদের নাম ওই এলাকাটিকে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ার কিংবা নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ারের মতো ঝলমলে করে তুলেছে। আমরা নতুন রেস্তোরাঁগুলোর প্রলোভন এড়িয়ে পুরনো জায়গাতেই যাই। সেখানে বসিবার বিভিন্ন কায়দার নিচু সোফা ও চেয়ার পেতে রাখা।
আমাদের আলোচনার একটি অংশ জুড়ে থাকে সন্তানভাবনা। আমরা উপলব্ধি করি এই পৃথিবীতে আমরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমাদের সন্তানদের, তাদের মঙ্গলকামনা আর নিরাপত্তা নিয়ে মগ্ন আমাদের উদ্বেগভরা মন। জীবনসূর্য যে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে তা প্রতিদিন টের পাই আমরা আর দিনাবসানের আগে দেখে যেতে চাই পূর্বাকাশের সূর্যরা নিজ নিজ সৌরমণ্ডলে প্রদীপ্ত জ্বলছে। কবিরুল বলে, আমরা আর আমাদের সন্তানরা দুটো ভিন্ন প্রজন্মের, আমরা যতই আমাদের শৈশব- কৈশোরের সংগ্রামের কথা সন্তানদের বলি, তারা তা অনুভব করে না, করতে পারবে না, কারণ তারা সে জীবন যাপন করেনি, অভাব ও সংগ্রাম দেখেনি। আমরা তাদের এতটা স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামের ভেতর রেখেছি যে দারিদ্র্য কী, ক্ষুধা কী, অর্থাভাব বলতে কী বোঝায় তারা তা জানে না।
জীবনের অনিত্যতা আমাদের উদাস ও বিমর্ষ করে। আমরা তো বটেই, আমাদের প্রাণপ্রিয় সন্তানেরা, এমনকি তাদের সন্তানেরা একদিন এ পৃথিবীতে থাকবে না। আমরা হয়তো আমাদের পিতামহের নাম জানি, বা বড়োজোর পিতামহের পিতার নাম। এরপর? কিন্তু তারা তো এ পৃথিবীতে ছিল, আমরা তো তাদের জিন বহন করে চলেছি আমাদের জিনে। কবিরুলের বাবা ও মায়ের পরিবারের বিপুল সংখ্যক ভাই-বোনের মধ্যে সবাই পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন; বেঁচে আছেন একজন চাচা ও কবিরুলের মা।
কবিরুল বল্ল, আমরা যেখানে বসে আছি ২০০ বছর আগে এখানে এই দালান, সড়ক, কোলাহল ছিল না, কী ছিল তাও আমরা জানি না, হয়তো জঙ্গল বা ঘাসময় মাঠ ছিল। সে মাঠে বসে দুজন বন্ধু, আমাদের মতোই হয়তো আলাপ করছিল। তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও বর্তমানের এই পরিবেশ ছিল না, আমরা ছিলাম না। আগামী ২০০ বছরে এই জায়গাটি কেমন হবে, কীরূপ বদলে যাবে, আমরা জানি না। হয়তো তখন দুজন বন্ধু গল্প করবে, তাদের কল্পনা করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। আমাদের সন্তানদের সন্তান, তাদের সন্তানেরা কী করবে, কীভাবে জীবনযাপন করবে আমরা ধারণাও করতে পারব না।
‘কালের পৃষ্ঠায় আমরা সবাই dot (বিন্দু) হয়ে যাব,’ আমার কন্ঠে বিষন্নতা ঝরে পড়ে। ‘Not even dots; we will simply vanish’ আমরা যে ছিলাম এটাই জানবে না কেউ। তাহলে এই যে ইঁদুর দৌড়, এই যে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা, এই কীর্তি, ওই উঁচুপদ, এই সম্পদের পাহাড় বানানো, ওই গদী কেড়ে নেওয়া- সব অর্থহীন। চূড়ান্তবিচারে তো তাই, কবিরুল প্রত্যয়ের সাথে বলে। কিন্তু এ মুহূর্তটি real, আমরা যে এ মুহূর্তে বসে আছি এটা বাস্তব। আমাদের কাজ হলো বর্তমানকে উপভোগ করা, খ্যাতি, সাফল্য, কীর্তিকে মহাকালের হাতে ছেড়ে দেওয়া।
বর্তমানকে উপভোগ করার জন্য এলো টুনা স্যান্ডউইচ, ক্রিমরোল, পেস্ট্রি কেক ও লাতে কফি। আমার বন্ধুটি খুব উদার, খাবারের বিল সবসময় সে-ই পরিশোধ করে। আজও করল, শুধু তাই নয়, সে আমার যমজ পুত্রদ্বয় শান্ত ও প্রান্তর জন্য দুটো ক্রিমরোল ও দুটো রেড ভেলভেট কেক কিনে দিল। শান্ত প্রান্ত হুবহু এক দেখতে ( identical twins)। অবাক হয়ে দেখি ক্রিমরোল ও কেক দুটোও হুবহু এক দেখতে। আমরা যখন ওখানে বসেছিলাম তখন প্রথমে শান্ত, পরে প্রান্ত ফোন করে। ‘বাবা তুমি কোথায়? কখন বাসায় আসবে?’ এই ছিল পুত্রদের জিজ্ঞাসা। শুনে আমার বন্ধু বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল ইসলাম বলে, ‘তুমি অনেক ভাগ্যবান পিতা।’
Leave a Reply