১৯৮৪ সাল। আমি আর শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম সত্যজিৎ দর্শন শেষে ঢাকায় ফিরছি কোলকাতা থেকে। বেনাপোল-বনগাঁ বর্ডারে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলো। আমাদের চোখের সামনে কোলকাতা বর্ডার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা তাড়াহুড়ো করে ইমিগ্রেশনের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করছি।
তিনচারজন দালালের খপ্পড়ে পড়লাম। ওরা বললো–দাদা আপনারা তো আজ আর বর্ডার ক্রস করতে পারবেন না। অই যে দেখুন আসল লোকটাই চলে যাচ্ছে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে। আজ আপনাদের সারারাত এইখানেই কাটাতে হবে দাদা। তারচে দু্ছো রুপি ছাড়ুন, ইমিগ্রেশনের ওই বড় কত্তাকে ধরে একটা সিল লাগিয়ে দেবার ব্যাবস্থা করে দিচ্চি। এমনিতেই ওই বড় বাবু খুব বদরাগী। আর আপনারা পড়েচেন ওই বদরাগী বাবুরই হাতে!
আলী ইমাম ভাই প্রায় রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি বললাম–লাগবে না। আমরা কোনো অবৈধ মাল নিয়ে যাচ্ছি না যে তার জন্যে আপনাদের দুশো রুপি ঘুষ দিতে হবে।
আমার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো দালালরা। ওদের একজন অন্যজনকে বললো–এই লাল ছার্টটাকে(আমার পরনে লাল শার্ট ছিলো) ছেকসন চৌছট্টিতে ফেলতে হবে।
আলী ইমাম ভাই কিছুটা ঘাবড়ে গেছেন। আমাকে ফিসফিস করে বললেন–টাকাটা আমিই দিচ্ছি। তুমি খামোখা ঝামেলায় জড়িও না।
আমি বললাম–ভয়ের কিছু নেই। আমি শেষ চেষ্টাটা করি।
একটা দালাল বললো–যান দাদা যান, বড়বাবুর একটা ঝাপ্টা খেয়ে আছুন।
দুটো পাসপোর্ট নিয়ে দৌড়ে গেলাম আমি বর্ডারের শেষ ধাপের শেষ কর্তার কাছে। তিনি তখন সত্যি সত্যি আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপ বন্ধ করছেন। শুধু তালা মারা বাকি। আমি গিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম–সরি আমাদের একটু দেরি হয়ে গেছে। কাইন্ডলি যদি একটু…
ভদ্রলোক খুব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। তারপর আমাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন–আরে! আপনি একজন লেখক না? কিছুদিন আগে একটা বইয়ের লাস্ট কভারে আপনার ছবি আমি দেখেছি। ঢাকাকে নিয়ে লেখা ছড়া। একজন যাত্রী কলকাতা যাবার সময় আমাকে দিয়ে গিয়েছিলো।
আমি বললাম–জ্বি। ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ নাম, বইটার। (ওটা সেই বছরই বেরিয়েছিলো।)
–পড়েছি আমি ওটা। দেখুন তো কী কাণ্ড! সেই আপনিই কিনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে!
এরপর ঝাঁপ খুলে ড্রয়ার থেকে সিল-প্যাড বের করে আমাদের দু’জনার পাসপোর্টে ধামাধাম দু’টো ক্লিয়ারেন্স ছাপ্পড় মেরে দিলেন ভদ্রলোক।
আলী ইমাম ভাই এবার বইমেলায় খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ঘটনাটা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন–আমি কিন্তু সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম রিটন। সেই লোকটা যখন বলছিলো–এই লাল ছার্টটাকে ছেকসন চৌছট্টিতে ফেলতে হবে–হাহ হাহ হাহ।
একটা বইয়ের ব্যাক কভারে ছাপা হওয়া লেখকের ছবি যে কতোটা জরুরি সেটা ১৯৮৪ সালের সেই ঘটনাতেই প্রথম টের পেয়েছিলাম! (ছবিটা তুলে দিয়েছিলো আমার আলোকচিত্রী বন্ধু বাতেন সিরাজ। সে তখন সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় কাজ করতো।)
আজ ছত্রিশ বছর পর, ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ বইটার প্রচ্ছদটা দেখে ১৯৮৪ সালের বেনাপোল-বনগাঁ কোলকাতা বর্ডারের সেই সন্ধ্যার গল্পটা মনে পড়ে গেলো।
একজন লেখকের একটা বইয়ের সঙ্গে কতো গল্পই না জড়িয়ে থাকে!
অটোয়া ৩০ নভেম্বর ২০২০
Leave a Reply