সেন্ট্রাল পার্কে যাবো। ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউর ফিফটি নাইন পাতাল রেল স্টেশনে নামলাম। দু’কদম হেঁটে সেন্ট্রাল পার্কের গেটের সামনে দাঁড়াতেই প্রথমে আমার দৃষ্টি কাঁড়লো এক নারীমূর্তি। সনাতন স্টাইলের একটি বিশাল ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন সেই নারী। ফুল সাইজের এক ব্রোঞ্জমূর্তি। কে সে! আমি তো আতিপাতি খুঁজছি তার পরিচয়। মাথার ওপর খাড়া সূর্য, প্রচন্ড রোদ। ব্রোঞ্জমূর্তিটির ছবি তুলতে ব্যস্ত আমি।
এমন সময় এক মাঝ বয়সী পর্যটক আমাকে ডেকে বললেন, তুমি কি জানো কে এই নারী? আমি না সূচক মাথা নাড়লাম।
ভদ্রলোক বললেন, তিনি একজন খুব বিখ্যাত আমেরিকান ফটোগ্রাফার। আজই এখানে তার এই ব্রোঞ্জমূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছে। গেটের পাশে দেখ তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া আছে।
আমি তো অভিভূত। ইউরোপিয়ান ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি এই ফটোগ্রাফারের আরও কিছু ছবি তুলে নিলাম। এক নিমিশে পড়ে নিলাম তার সংক্ষিপ্ত পরিচয়। পরে জানলাম আরও অনেক কিছু…।
ডায়ান আরবাস; আমেরিকান নারী ফটোগ্রাফার। নিউইয়র্কের এক ধনী ইহুদি পরিবারে ১৯২৩ সালের ১৪ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন নিয়ে ফটোগ্রাফি করার জন্য তিনি বিখ্যাত। তার পূর্বপুরুষরা ভাগ্যোন্নয়নে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া থেকে এসেছিলেন আমেরিকায়। স্থিত হয়েছিলেন এই ম্যানহাটনে, করতেন ব্যবসা।
নিউ ইয়র্কে জন্ম এবং পড়াশুনা করা ডায়ান আরবাস পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কর্মাশিয়াল ফটোগ্রাফিকে। তিনি তার তোলা ছবিগুলোর মাধ্যমে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচার তুলে ধরেন। আলাদা করে বোঝাতে চেয়েছেন ওইসব মানুষেরও স্বপ্ন আছে, আছে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার।
ছবিতে তিনি প্রান্তিক জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নাকে তুলে ধরেছেন, তুলে ধরেছেন নানা অনুষঙ্গকে। ক্যামেরার মাধ্যমে তুলে এনেছেন মানুষের জৈবিক চাহিদাকেও। পুরুষ-নারীর বাইরেও যে একটা লিঙ্গ আছে এবং তাদেরও জৈবিকসহ নানা চাহিদা আছে তাও বুঝাতে চেয়েছেন স্থির চিত্রের মাধ্যমে।
হতদরিদ্র, বস্তিবাসী, অভিবাসী জীবন, ভবঘুরে, বিকৃত মানুষ, নগ্নতাবাদী, সমকামী, হিজরা, সার্কাসের অভিনেতাসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনকাহিনি তিনি নিখুঁতভাবে ক্যামেরাবন্দি করেছেন। তুলে এনেছেন সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনের নানা চিত্র।
পেশাগত জীবনে সেন্ট্রাল পার্কে তোলা তার অসংখ্যা সফল ছবি রয়েছে। তাই তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ প্রজন্মের সামনে নতুন করে তার অবদানকে তুলে ধরতে পার্কের এই গেটের সামনে তার এই ব্রোঞ্জমূর্তিটি আজ ২০ অক্টোবর ২০২১ স্থাপন করেছে পাবলকি আর্ট ফান্ড নামের একটি স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা। মূর্তিটি এখানে থাকবে আগামী বছর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত।
ডায়ানের বয়স যখন ১৪ বছর তখন তার স্বামী অ্যালান আরবাসের সাথে তার প্রথম পরিচয় হয়। চার বছর পরে তারা বিয়ে করেন। অ্যালানও ফটোগ্রাফার ছিলেন। পরে তিনি অভিনেতা হিসেবেও খ্যাতি পান। ডায়ান ও অ্যালানের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ডন আরবাস লেখক এবং ছোট মেয়ে এমি আরবাস মায়ের পথ অনুসরণ করে ফটোগ্রাফার হয়েছেন।
ডায়ান পরে স্বামীর উৎসাহে ফ্যাশন ফটোগ্রাফার হিসেবেও কাজ করেছেন। বর্গ, হার্পার বাজার’এর মত ব্যাপক জনপ্রিয় ফ্যাশন ম্যাগাজিনে তিনি ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন।
ডায়ান আরবাস ১৯৬৭ সালে নিউইয়র্ক যাদুঘরের আধুনিক আর্ট গ্যালারীতে প্রদর্শনী করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেন। প্রদর্শনীতে যে ছবিগুলি দেখিয়েছিলেন সেগুলো বোদ্ধাদের প্রচুর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই তিনি নিউইয়র্কের একটি অ্যাপার্টমেন্টে নিজের ঘরে আত্মহত্যা করেন। আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর আগে হতাশাগ্রস্থ ডায়ান বার্বিটুয়েট্রেস খাওয়ার পরে কব্জি কেটে আত্মহত্যা করেন।
আত্মহত্যা করার পরের বছর তার তোলা বেশ কিছু ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ১৯৭২ সালে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীটি দুই মাসের মধ্যে দুই লাখ দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
এই প্রদর্শনী উপলক্ষে তার মেয়ে ডন আরবাস এবং মারভিন ইসরায়েল সম্পাদিত ‘ডায়ান আরবাস: অ্যান অ্যাপারচার মোনগ্রাফ’ বইটি প্রকাশিত হয়। বইটি সে বছর ‘হট সেলার’ হয়েছিল।
২০০৬ সালে মোশন পিকচার এই ফটোগ্রাফারকে নিয়ে একটি সিনেমা নির্মান করে। যার নাম ‘আরবাস’। হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী নিকোল কিডম্যান নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। ডায়ান আরবাসের জীবনের গল্প উঠে আসে এই চলচ্চিত্রে।
Leave a Reply