আসাদ ভাই মানে কবি আসাদ চৌধুরী এখন কানাডায় থাকেন। স্থায়ীভাবেই কানাডায় চলে এসেছেন তিনি পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে থাকবেন বলে। আমার নিবাস অটোয়ায়। পাশের শহর অশোয়াতেই পুত্রের সঙ্গে বসবাস আসাদ-শাহানা জুটির। মাঝে মধ্যে শাহানা ভাবীকে নিয়ে আসাদ ভাই অটোয়ায় আমার ডেরায় আসেন। সেদিন আমার বাড়িতে ঈদের আনন্দ। মহা উৎসাহে দুই তিন দিনের রান্না প্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়ে শার্লি। এই আইটেমটা আসাদ ভাইয়ের প্রিয়। ওই আইটেমটা ভালোবাসেন তিনি। এইভাবে তালিকায় যুক্ত হতে থাকে সুস্বাদু সব খানাখাদ্য।
আসাদ ভাই শুধু আমাকেই দেখতেই আসেন না। শার্লিকেও তিনি খুব ভালোবাসেন। শার্লিরও খুব প্রিয় মানুষ আসাদ ভাই। আসাদ ভাইকে দেখলেই শার্লির মন ভালো হয়ে যায়। আমাদের বাড়িতে আসাদ ভাই আসা মানে সারাদিন শুধু খাওয়া আর আড্ডা। কতো যে কথা আমাদের! আমার কথায় হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন আসাদ ভাই। এলিয়ে পড়েন সোফায়। আসাদ ভাইয়ের এই ছাদ কাঁপানো হাসিটা আমার ভীষণ প্রিয়।
শাহানা ভাবী পোশাক আশাকে অনেক বদলে গেছেন। মাথাটা বিশাল একটা ঘোমটায় ঢেকে অনাবশ্যক গম্ভীর থাকার চেষ্টা করেন প্রথমে। কিন্তু আমার ধুন্দুমার কথাবার্তায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোমটার আড়াল থেকে চিরচেনা হাস্যোজ্জ্বল শাহানা ভাবীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। হাসির ক্ষেত্রে ক্লান্তিহীন আমাদের শাহানা ভাবী।
আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ব্যাখ্যাতীত। আমার সঙ্গে এবং শার্লির সঙ্গেও অকপটে তিনি নিজের জীবনের গভীর গোপন জটিল অনুষঙ্গগুলো আলোচনা করেন। আমাদের তিনি নিজের পরিবারের অংশী ভাবেন বলেই এমনটা ঘটে।
কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বয়ান করতে হলে একটু পেছনে তাকাতে হবে। ২০১২ সালে একটা স্মৃতিগদ্য লিখেছিলাম তাঁকে নিয়ে। একটু চোখ বোলানো যেতেই পারে সেই স্মৃতিগদ্যে—
০২
”কবি আসাদ চৌধুরীকে গোপনে আমি ‘অপূর্ব চৌধুরী’ বলি। আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যাক্তিগত পর্যায়ের ঘনিষ্ঠতা চার দশকেরও বেশি। এই চার দশকে আমি বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে একমাত্র আসাদ চৌধুরীকেই দেখেছি নিন্দাহীন। প্রশংসা ছাড়া আসাদ চৌধুরীর মুখ থেকে নিন্দাবাক্য কখনোই শুনিনি। ‘বাহ্ অপূর্ব’ বলে একেবারেই অপরিচিত নবীন কবির কবিতার প্রশংসা একমাত্র আসাদ চৌধুরীর পক্ষেই সম্ভব। আর সে কারণেই সারাদেশের নবীন তরুণ কবিদের কাছে আসাদ চৌধুরীর জনপ্রিয়তা ছিলো ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। শামসুর রাহমানও তাঁর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। যে কোনো প্রকাশনা উৎসবে আসাদ চৌধুরীই একমাত্র বক্তা থাকতেন যাঁর বক্তৃতায় ‘আলোচ্য লেখক’ যথার্থ লেখকের সম্মান ও মর্যাদায় অভিষিক্ত হতেন।
শৈশব থেকেই আমি কবি আসাদ চৌধুরীর একজন মহাঅনুরাগী। চিত্তরঞ্জক রাজপুত্তুরের মতো চেহারা, আনবিটেবল একজোড়া গোঁফ, প্রবল পরাক্রমশালী হাসি আর হিরন্ময় কণ্ঠ—এই সবকিছু মিলিয়ে আসাদ চৌধুরী ছিলেন আমার কাছে হিরো। কী অসাধারণ বক্তৃতা করতেন! মাইক্রোফোনে তাঁর কণ্ঠ হিরকদ্যুতির মতো ছড়িয়ে পড়তো অডিটোরিয়ামে। বিটিভিতে ‘প্রচ্ছদ’ নামে শিল্পসাহিত্য ভিত্তিক একটি পরিচ্ছন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। সেতারের অপূর্ব একটি মূর্ছনা ছিলো প্রচ্ছদের টাইটেল সং। তখন এই একটিমাত্র চ্যানেলই ছিলো বাংলাদেশে, আর তাই সারাদেশের কোটি দর্শকের চোখ আটকে থাকতো বিটিভি পর্দায়।
আশির দশকের সূচনায় আমি যখন নিতান্তই একজন কিশোর ছড়াকার, কোনো গোণাগুনতিতেই পড়ি না, তখন কবি আসাদ চৌধুরীই প্রথম আমাকে এবং আমার সতীর্থ কয়েকজন অতিনবীন ছড়াকারকে তুলে ধরেছিলেন তাঁর প্রেস্টিজিয়াস অনুষ্ঠান ‘প্রচ্ছদ’এ। এই অনুষ্ঠানে তবলার তালে তালে আমি পাঠ করেছিলাম ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ নামের ছড়াটি। আমার ছড়ার সঙ্গে সঙ্গত করার জন্যে আসাদ ভাই বিটিভির একজন বিশিষ্ট তবলাশিল্পীকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন। সেদিন আমার সঙ্গে আরো ছিলো আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল-ফারূক, সৈয়দ নাজাত হোসেন এবং আনওয়ারুল কবীর বুলু। আসাদ ভাইয়ের বিখ্যাত অনুষ্ঠানে ছড়া পড়ার পর চলতিপথে রাস্তায় লোকজন আমাকে অবাক বিস্ময়ে শনাক্ত করতো—‘ আরে আপ্নেরেই তো সেইদিন টিভিতে দেখ্ছি!’
পঁচাত্তর সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’-এর নামটা আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। এরপর ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই’ ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়’ ‘জলের মধ্যে লেখাজোখা’ এবং ‘দুখিরা গল্প করে’ নামের কবিতার বইগুলোও আমাকে টেনেছিলো প্রচুর। আহা কী অসাধারণ নাম একেকটা বইয়ের!
উন্মুক্ত মঞ্চে দর্শক উপস্থিতিতে কবিতা পাঠের আসরে আসাদ ভাই থাকা মানেই ছিলো অভাবনীয় কিছু একটা দেখার অভিজ্ঞতা অর্জনের বিপুল সম্ভাবনা।
১৯৭৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরে বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে সেই অভিজ্ঞতাটাই অর্জিত হয়েছিলো আসাদ ভাইয়ের কল্যাণে। আমার লেখা স্মৃতিগদ্য থেকে (‘একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে বাংলা একাডেমীর কবিতা পাঠের আসরে’ শিরোনামে আমার একটি রচনা ছাপা হয়েছিলো ২০১০ সালে, বাংলা একাডেমীর একুশের স্মারকপত্রে।) দৃশ্যটা উদ্ধৃত করি। তার আগে বলে রাখি—সেই আসরে আমাদের ১০ জন তরুণ ছড়াকারকে ছড়া পাঠ করতে দিচ্ছিলেন না অনুষ্ঠান পরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। অনেক কায়দা করে আমার নাছোড় একগুঁয়েমি, ছড়াকার আবু সালেহ-এর বুদ্ধিমত্তা এবং মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকীর সরাসরি হস্তক্ষেপে আমার দেয়া লিস্টি অনুয়ায়ী কবি নুরুল হুদাকে বাধ্য করা হয়েছিলো আমাদের নাম ঘোষণ করতে। একুশের স্মারকপত্র থেকে উদ্ধৃত করছি—
‘‘(১৯৭৯ সালের একুশের সকাল)……তারপর তিনি(ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী) টুকরো কাগজে লেখা তালিকাটি তাঁর(নুরুল হুদার) হাতে সমর্পন করলেন। এবং আধাবিষণ্ন আধা প্রসন্ন মুখে ফিরে এসে বললেন—হুদা এখনি ডাকবে। যাও ছড়া পড়ো। কিন্তু একটার বেশি পড়বা না। কবিদের বিশাল লিস্টি নিয়া বসছে হুদা,হুদার মাথার ঠিক নাই এখন।
কিন্তু হুদার মাথা ঠিকই ছিলো। কারণ কিছুক্ষণ পরেই তিনি মাইকে ঘোষণা করলেন—এখন আমি কয়েকজনের নাম ঘোষণা করবো যাঁরা নিজেদের কবি নয়, ছড়াকার বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। এঁরা হচ্ছেন অমুক অমুক অমুক এবং লুৎফর রহমান রিটন। প্রথমেই ছড়া পড়বেন……বলে তিনি তালিকার সবচে নিচে থাকা আমার নামটাই ঘোষণা করে বসলেন।
হারাধনের দশটি ছেলের কয়েকটা ইতোমধ্যে পরিস্থিতি অনুকুলে নয় বিবেচনা করে এদিক-ওদিক সটকে পড়েছিলো। আমি সবাইকে জড়ো করার সুযোগই পেলাম না, মাইকে আমার নাম ঘোষণা করা হয়ে গেছে। এক দৌঁড়ে মঞ্চে উঠে গেলাম। বাংলা একাডেমী লোকে লোকারণ্য। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে পুলিশের নির্দেশিত পথ ধরে এগিয়ে এলে এমনিতেই বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়েই যেতে হয়। আর যাবার সময় ভেতরে কি হচ্ছে তা দেখার কৌতূহলজনিত কারণে খামোখাই লোকজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে বাংলা একাডেমীতে। বই কিনতে কিংবা কবিতা শুনতে আসেনা প্রায় কেউই। কিন্তু মঞ্চের সামনে সামিয়ানা আছে এবং ওখানে সারি সারি চেয়ার পাতা আছে সুতরাং হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত বাঙালি একটু জিড়িয়ে নিতে, পদযুগলকে একটু প্রশান্তি দেবার মানসে টপাটপ বসে পড়ে চেয়ারগুলিতে। আর সে কারণেই হাউজফুল পরিস্থিতি বাংলা একাডেমীর কবিতা পাঠের আসরটিতে।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে পকেট হাতড়ে দেখি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সঙ্গে ‘কবিতা পড়া যাবে না, কবিতা পড়তে দিতে হবে, সম্ভব না, দিতে হবে–গত ঘন্টা দেড়েকের এরকম উত্তেজনা আর টেনশনে আমার ছড়াটাই ফেলেছি হারিয়ে! কী আর করা। সম্প্রতি লেখা অপ্রকাশিত সেই ছড়াটা মুখস্ত ঝেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমবেত জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম—কনতো দেহি আইজকা দ্যাশে/সবচে শরীল তাজা কার? জনগণ জবাব দেবে কি আমিই জবাব দিলাম—যেই শালারা রাজাকার!
আর যায় কোথায়, লাইনটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন ফেটে পড়লো উল্লাসে। ওদের সমবেত উল্লাসধ্বনি আমার ভেতরের চেতনাগত স্পিরিটটাকে মুহূর্তেই গুণ গুণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো। অতঃপর আমি স্মৃতি হাতড়ে পরের পংক্তিটি আওড়ালাম—পাল্টে লেবাস কোন ব্যাটারা/আজ সমাজে পায় কদর?/যেই শালারা আলবদর!
বলবার সঙ্গে সঙ্গেই অভাবনীয় কাণ্ড! সমবেত জনতার উল্লাসধ্বনির ভেতরে দর্শক সারিতে সামনের আসনে বসে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে ফেটে পড়লেন। আর তাঁর দেখাদেখি অন্যান্য আসনে উপবিষ্ট লোকজনও উঠে দাঁড়ালেন করতালি দিতে দিতে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সামিয়ানার শেষ দিকটায় চলমান জনতার ভিড়টা দুধের সরের মতো ঘন হয়ে কেমন যেন থমকে গেছে। কেউ নড়ছে না,হাঁটছে না।
এরপর আমার ছড়ার পরের পংক্তি—গদির পাশে বইছে ক্যাডা?/পান খাওয়া মুখ যা লাল রে!—একাত্তুরের দাদাল রে।
পড়া মাত্রই হাজার হাজার মানুষের উল্লাস যেনো আর থামতেই চায়না। আমাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো।
অতঃপর পাঠ করলাম আমার ছড়ার শেষ স্তবক— আপনেরা কন ঊনাশিতে/আমরা অগো কি করুম?/–ভাইজা তেলে ঘি করুম!
মানুষের সে কী প্রতিক্রিয়া! মানুষের ভেতরের জমাট বাঁধা ক্ষোভ-ঘৃণা আর প্রতিরোধের চেতনাকে ছড়াটার ছন্দ আর বক্তব্য মিলে প্রবল এক ঝাঁকুনি দিয়েছে। দীর্ঘ দিনের পাথরচাপা সময় তাদের ভেতরে সৃষ্টি করেছিলো নৈরাশ্যের দমবন্ধ এক গুমোট পরিস্থিতির। সেই পাথরচাপা সময়ের আগল যেনো ভেঙ্গে গেলো। ওয়ান মোর ওয়ান মোর বলে ফেলেছিলো কয়েকজন কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির কথা চিন্তা করেই বোধ হয় বাক্যটার বাংলা অনুবাদ হয়ে গেলো দ্রুত—আবার পড়েন আবার পড়েন ধ্বনিতে।
এবং আমাকে পুনরায় পড়তে হলো ছড়াটা!
আমার পরে একে একে ছড়া পড়লেন আবু সালেহ, আসলাম সানী,সৈয়দ আল ফারুক,সরকার জসীম,আবু হাসান শাহরিয়ার,আবদুর রহমান,আনওয়ারুল কবীর বুলু, সৈয়দ নাজাত হোসেন, খালেক বিন জয়েনউদ্দীন। প্রত্যেকেই মাতিয়ে রাখলেন সময়টা বিচিত্র সব বিষয়ের ওপর বৈচিত্র্যময় ছড়া পাঠ করে। আমাদের ছড়াকারদের পড়া শেষ হলে আবারো শুরু হলো কবিদের কবিতা পাঠ। প্রথমেই নাম ঘোষিত হলো জাহিদ হায়দারের। জাহিদ হায়দার তাঁর কবিতার কয়েকটি চরণ পড়ার পর দর্শকদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়লেন–ছড়া শুনতে চাই, ছড়া শুনতে চাই, আরো ছড়া…।
পরিস্থিতি সামাল দিতে মুহম্মদ নূরুল হুদা ঘোষণা করলেন কবি আসাদ চৌধুরীর নাম। চমৎকার চেহারা অপরূপ কণ্ঠস্বর আর অসাধারণ বাচনভঙ্গির সমন্বয়ে আসাদ ভাই পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে ছোটোখাটো একটা বকৃতাও দিয়ে ফেললেন। আমাদের প্রতি বিপুল প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করে আসাদ ভাই বললেন—রিটনদের পরে কবিতা পড়তে যাওয়াটা খুবই বিপজ্জনক। বলেই আসাদ ভাই তাঁর অনন্যসাধারণ কণ্ঠ ও ভঙ্গিমায় ‘সত্য ফেরারী’ পাঠ করে দর্শক শ্রোতার মন জয় করে ফেললেন। পরিস্থিতি কবিদের আরো বেশি অনুকূলে নেবার দায়িত্ব এবং তাগিদে আসাদ ভাই পড়লেন আরেকটি কবিতা—ওদের হাতে ঘড়ি তো নেই সূর্য হলেন ঘড়ি/কয়েক ছটাক চালের ডালের/….মরিচ লবণ আনাজপাতির/ যোগাড়যন্ত্র করতে করতে করতে করতে……(স্মৃতি থেকে লিখছি)।
এই কবিতার শেষ শব্দ—করতে করতেটা আসাদ ভাই আপন কণ্ঠস্বরেই ইকো ইফেক্ট ইম্পোজ করলেন অপরূপ ক্যারিশম্যাটিক দক্ষতায়। এবং করতে করতে করতে করতে উচ্চারণ করতে করতে আসাদ ভাই মাইক্রোফোন থেকে মুখটা একটা নির্দিষ্ট রিদমে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিলেন পেছন দিকে কয়েক কদম। আর তাতে করে মনে হলো লোকটা মানে কবিতার সেই চরিত্রটা ক্রমশঃ অনেক দূরবর্তী কোনো পাহাড়ের গুহায় মিলিয়ে গেলো! আমি আমার পরবর্তী জীবনে আর কোনোদিন আসাদ ভাইয়ের এইরকম অলৌকিক জাদুকরী পারফরম্যান্স দেখিনি। কবিদের মর্যাদা রক্ষায় আসাদ ভাই সেদিন তাঁর সমস্ত মেধা এবং সর্বোচ্চ শক্তির প্রয়োগ করেছিলেন। সেই থেকে আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার চিরকালের খাতিরের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেলো।’’
হ্যাঁ, কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার চমৎকার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলো। তখনো আমার কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু আসাদ ভাই আমাকে বরাবর একজন লেখকের সম্মান ও মর্যাদা দিতে এতোটুকু কার্পণ্য করেননি। (এই রচনার সঙ্গে জুড়ে দেয়া ছবিটা ১৯৮১ সালের। বাংলা একাডেমীর ছাদে তোলা এই ছবিতে আমার সঙ্গে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বন্ধু সৈয়দ বেলাল আহমদ। বেলাল বর্তমানে বিরাট ধনাঢ্য ব্যবসায়ী)।
বাংলা একাডেমীতে তখন কাজ করতেন কবি রফিক আজাদ,আসাদ চৌধুরী, কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন, রশীদ হায়দারের মতো একঝাঁক মেধাবী দেশবরেণ্য মানুষ। এঁদের সান্নিধ্যের লোভে মাঝে মধ্যেই কাজে অকাজে তখন বাংলা একাডেমীতে গিয়ে বসে থাকতাম। আমার বিকশিত হবার সেই সময়টায়, সত্তুর এবং আশির দশকের সেই সময়টায় সবচে বেশি প্রশ্রয় পেয়েছিলাম কবি আসাদ চৌধুরীর কাছ থেকে। আমার প্রথম বই ‘ধুত্তুরি’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮২ সালে। সে বছরই বইটির জন্যে আমি অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলাম ছড়া কবিতা বিভাগে। অনুবাদ বিভাগে ‘ছোট্ট রাজপুত্র’ বইয়ের জন্যে পুরস্কার পেয়েছিলেন আসাদ চৌধুরী। আমার জন্যে ব্যাপারটা খুবই গৌরবের ছিলো। কারণ আমি কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে পুরস্কৃত হয়েছি!
একটা পর্যায়ে খেয়াল করলাম আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ব্যাক্তিগত থেকে পারিবারিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আসাদ ভাইয়ের কন্যা শাঁওলীর বিয়েতে আমি আর আমার স্ত্রী-কন্যাও আমন্ত্রিত। আমাদের ছোট্ট শাঁওলীরও বিয়ে হয়ে গেলো! ওর বিয়ের পর আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় আসাদ ভাই আর শাহানা ভাবী তাঁদের কন্যা এবং নতুন জামাতাবাবুকে নিয়ে বেড়াতে এলেন। অনেক মজা করলাম আমরা।
এই শাহানা ভাবীর সঙ্গে কথা বলে আমার কখনোই মনে হয়নি তিনি আমাকে একজন ছড়াকার বা লেখক হিশেবে জানেন বা চেনেন। কোনোদিন তিনি আমার লেখালেখি নিয়ে একটি বাক্যও বলেননি। কিন্তু তাঁর সঙ্গেই ঘটলো আমার অবাক করা ঘটনাটি! তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া হলো অন্যরকম প্রতিক্রিয়া। জীবনে আমার ছড়ার বহু পাঠপ্রতিক্রিয়া কিংবা শ্রুতি প্রতিক্রিয়া আমি পেয়েছি কিন্তু শাহানা ভাবীর কাছ থেকেই কীনা পেলাম সবচে অনন্যটি!
ঘটনাটা বলি।
২০০১ সালের মাঝামাঝি প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী অলোক বসুদের সংগঠন থেকে পাবলিক লাইব্রেরী অডিটোরিয়ামে অন্যরকম একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। সেই অনুষ্ঠানে কবি রফিক আজাদ, কবি আসাদ চৌধুরী আর আমি ছিলাম মঞ্চে। আমাদের কবিতা আর ছড়া নিয়ে এবং আমাদের সম্পর্কিত খুঁটিনাটি টুকটাক বিষয়ে বক্তৃতা করলেন লেখক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। আমাদের কবিতা আর ছড়া নিয়ে গান গাইলেন ভরাট কণ্ঠের গুণী শিল্পী মহিউজ্জামান চৌধুরী ওরফে ময়না। তাঁর গাওয়া আমার লেখা ছড়াটি ছিলো—‘পথের গল্প বলি শোনো হে পথিক/কোন্ পথে যাবে তুমি আগে ভেবে নাও/পথ তোমাকেই ঘিরে আছে চারিদিক/প্রথমে মনস্থির তারপরে যাও…’।
দর্শকদের বিপুল করতালির মধ্যে আমরা তিনজনই একের পর এক পাঠ করেছিলাম অনেকগুলো লেখা। আমার কিছু রাজনৈতিক ছড়াও আমি পড়েছিলাম সেদিন। অডিটোরিয়াম ভর্তি ছিলো দর্শক। খুবই ছিমছাম নিটোল স্নিগ্ধ একটি অনুষ্ঠান ছিলো সেটা।
অনুষ্ঠানে আতর নিয়ে লেখা আমার একটা ছড়া দর্শকদের বিপুল ভালোবাসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছিলো। ছড়াটার পটভূমি ছিলো সংক্ষেপে এরকম–১৯৯৯ সালের ০১ ডিসেম্বর বিভিন্ন দৈনিকে ছবিসহ একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরে বলা হয় চারদলের নেতাদের সেই বৈঠকে একাত্তরের ঘাতক জামাতের গোলাম আযম ‘বেগম খালেদা জিয়া এবং এরশাদসহ অংশগ্রহণকারীদের সবাইকে আতর মাখিয়ে দেন’।
এই বৈঠকেই ‘চারদলীয় জোট’ আত্মপ্রকাশ করেছিলো। এই বৈঠক থেকেই সাতচল্লিশের চেতনায় ফিরে যাবার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছিলো। গোআযম কর্তৃক আতর বিলানোর খবর পাঠ করে তাৎক্ষণিকভাবে আমি লিখেছিলাম ‘আতর নিয়ে ছড়া’।
ছড়াটা দু’একদিন পরেই ছাপা হয়েছিলো জনকণ্ঠে। রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে সেই ছড়াটাও আমি পাঠ করেছিলাম অলোকদের অনুষ্ঠানে। স্মৃতি থেকে ছড়াটার কয়েকটা চরণ উদ্ধৃত করি এখানে—
‘‘কেউ কখনো ভেবেছিলো আতর নিয়েও লিখতে হবে ছড়া?/
আতর ছিলো পবিত্রতায়, আতর ছিলো সুগন্ধিতে ভরা।/
আতরে কি পচন ধরে? অপব্যবহারে কি তার নতুন ইমেজ দাঁড়ায়?/
ঘাতক যখন আতর মাখে আতর তখন পবিত্রতা হারায়।/
ঘাতক যখন আতর বিলায় আতর তখন কাতর হয়ে পড়ে/
আতর কোনো দোষ করেনি, তবুও আতর যায় না রাখা ঘরে।/
ঘাতক তোমার শরীর থেকে আতর তো নয় খুনের গন্ধ আসে/
একাত্তুরে তুমি ছিলে টিক্কা খানের নিকট আশেপাশে!/
টিক্কা খানের জায়গা বদল, এখন সেথায় অন্য মুখের ছবি/
রাজনীতিবিদ সবকিছু খায়, হারাম হালাল সবই জায়েজ, সবই।/
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের আখের ঠিক গুছিয়ে নিলে/
ঘাতক তুমি আতর তো নয়, সবার গায়ে খুন মাখিয়ে দিলে!’’
অনুষ্ঠান শেষ হলে আমরা চলে গেলাম যে যার গন্তব্যে। পরদিন আসাদ ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম অদ্ভুত এক ঘটনা। ভোর রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠলেন শাহানা ভাবী। আসাদ ভাইকেও ডেকে তুললেন তিনি। ভাবীর দেখা দুঃস্বপ্নটা এরকম–তাঁর খুব একজন নিকটাত্মীয় মারা গেছেন । শাদা কাফনে মোড়ানো তাঁকে কবর দেয়া হচ্ছে। কফিনে আতরের ঘ্রাণ। আতরের ঘ্রাণে মশগুল চারপাশ। ঘুম ভাঙার পরেও আতরের ঘ্রাণ পাচ্ছিলেন তিনি। আসাদ ভাইকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন–এ আমি কি দেখলাম!
আসাদ ভাই বললেন—ঘুমাও শাহানা। কিচ্ছু হয়নি। সন্ধ্যায় রিটনের ছড়া শুনেছিলে তুমি। আতর নিয়ে রিটন একটা ছড়া পড়েছিলো। ওটাই ঢুকে গেছে তোমার মাথায়।
আসাদ ভাই আমাকে বলেছিলেন— তোমার ছড়াটা শাহানা নিশ্চয়ই শুনেছিলো খুব মনোযোগী শ্রোতা হয়ে। ওঁর নিশ্চয়ই খুবই ভালো লেগেছিলো ছড়াটা। অবচেতনে ছড়াটা ওঁর মস্তিস্কে গেঁথে গিয়ে থাকবে। সেই কারণেই তোমার ভাবীর স্বপ্নে আতরের এই বিড়ম্বনা।
এই ঘটনার কাছাকাছি সময়ে ২০০১ সালের মাঝামাঝিতে আমি দেশ থেকে ছিটকে পড়লাম। প্রায় সাত বছর দেশে যেতে পারিনি। কী যে কষ্ট! কী যে কষ্ট! নিজের দেশে যেতে না পারার কষ্ট! প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্য না পাবার কষ্ট! প্রিয় জায়গাগুলো না দেখার কষ্ট! বিএনপি-জামাত চারদলীয় জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেই টোকিও দূতাবাসে থাকা আমার ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালালো। আমার চাকরি গেলো। আমার পাসপোর্ট বাতিল হলো। নতুন পাসপোর্ট আর ইস্যু হয় না। সাতটা বছর আমাকে ঢুকতেই দিলো না বাংলাদেশে!
২০০৭ এর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রায় সাত বছর পর দেশে ফিরলাম। রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন মঈন-ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এক দুপুরে সিদ্ধেশ্বরীতে চ্যানেল আই কার্যালয়ে আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতেই দু’হাত বাড়িয়ে বিশাল একটা আলিঙ্গন। তারপর দ্রুত মুঠোফোনে ভাবীকে ধরেই বললেন—এই নাও রিটনের সঙ্গে কথা বলো।
শাহানা ভাবীর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই আমার আতরের ঘটনা মনে পড়ে যায়।
আমি যখন প্রবাসে, দেশে ফিরতে পারছি না, তখন, কবি আসাদ চৌধুরী আমাকে একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর অনুবাদ করা ছড়ার সংকলন ‘বিলেতি ছড়া’ নামের বইটার উৎসর্গ পাতায় আসাদ ভাই লিখেছিলেন—‘লুৎফর রহমান রিটন, খুব মিস করছি তোমাকে’।
প্রিয় আসাদ ভাই, বাংলাদেশ থেকে বারো হাজার তিনশ কিলোমিটার দূরের দেশ কানাডায় বসে আজ কেনো জানি আপনাকে খুব মিস করছি আমি। আর সে কারণেই স্মৃতির এলবাম হাঁতড়ে খুঁজে বের করেছি আমার শৈশবের প্রিয় একটা ছবি। যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে ১৯৮১ সালে আসাদ ভাই আপনার স্নেহ মাখা একটি হাত কিশোর ছড়াকার রিটনের পিঠে শক্তি আর প্রেরণার স্পর্শ দিচ্ছে। আমি জানি, মমতা মাখানো সেই হাত আজও প্রসারিত আমার দিকে।
আসাদ ভাই আপনি দীর্ঘজীবী হোন। জয়তু কবি আসাদ চৌধুরী।
রচনাকাল/ অটোয়া, ০৫ নভেম্বর ২০১২”
[ ক্যাপশন ০১/ এটা একটা ঐতিহাসিক ছবি। এন্টিকও বলা যেতে পারে। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে বাংলা একাডেমির ছাদ বারান্দায় কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে টিঙটিঙে শরীরের লুৎফর রহমান রিটন ও লন্ডন নিবাসী সৈয়দ বেলাল আহমেদ। সময়কাল সম্ভবত ১৯৮১]
[ ক্যাপশন ০২/ চ্যানেল আই স্টুডিওতে কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে উপস্থাপক লুৎফর রহমান রিটন। ‘শ্রদ্ধায়’ অনুষ্ঠানে আসাদ চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন লুৎফর রহমান রিটন।সময়কাল ০৬ মার্চ ২০১৭]
Leave a Reply