জাতির পিতা, ‘ফাদার অব দি নেশান’, একটি বহুল প্রচলিত শব্দগুচ্ছ। জাতি বলতে সেখানে অবশ্য স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্র বোঝায়, নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি ইঙ্গিত করে না। আমরা এ কথাও জানি যে, কোনো একক ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দেন না বা প্রতিষ্ঠা করেন না, কেউই শুধু তার একক চেষ্টায় পরাধীনতা বা ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে বিশ্ব মানচিত্রে কোনো নতুন একটি জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটান না। এর জন্য বহুকাল ধরে তীব্র কঠিন সংগ্রাম চলে, বহু নারী-পুরুষ সেই সংগ্রামে অংশ নেয়, নানাপ্রকার নিষ্ঠুর অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে, আত্মাহুতি দেয়। তবু আমরা এ কথাও জানি যে, ইতিহাসের কোনো কোনো পর্বে, কোথাও কোথাও একক ব্যক্তি এত বিশাল গগনচুম্বী সর্বপ্লাবী ভূমিকা পালন করেন, তার অবদান এত কেন্দ্রীয় ও চূড়ান্ত হয়ে ওঠে, ক্যাটালিটিক এজেন্ট হিসেবে তার কর্মকাণ্ড এত ফলপ্রসূ হয় যে, দেশের মানুষ তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তার মাথায় জাতির পিতার শিরোপা পরিয়ে দেয় এবং বিশ্ববাসীও তাকে সেইভাবে দেখে। এইভাবেই আমরা পেয়েছি ভারতের মহাত্মা গান্ধীকে, পাকিস্তানের কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে, নয়া-তুরস্কের আতাতুর্ককে এবং বাংলাদেশের শেখ মুজিবকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কেও সমগোত্রীয় শব্দগুচ্ছের প্রচলন আছে, তবে সেখানে বলা হয় প্রতিষ্ঠাতা-জনকগণ, ফাউন্ডিং-ফাদার্স।
যে পর্যায়ক্রমিক দীর্ঘকালব্যাপী রাজনৈতিক আন্দোলন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অবশ্যম্ভাবী ও অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল, তার প্রধানতম প্রাণপুরুষ ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির মাধ্যমে আমরা একটা মেকি স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, সে আন্দোলনের সঙ্গেও শেখ মুজিব জড়িত ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের প্রথমদিকে অন্যান্য দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল, ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী মুসলমান তরুণের মতো তিনিও মুসলিম লীগের হয়ে নানা সংগ্রামী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। নবলব্ধ পাকিস্তানে যে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারটি অগ্রাধিকার পাবে না, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আর্থিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সকল ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিক প্রত্যাশা এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক অধিকার যে এখানে শুধু উপেক্ষিত নয়, নিষ্পেষিত ও লজ্জিত হবে, সেটা বুঝতে তার দেরি হয়নি। এরই ফলে ১৯৪৮ সাল থেকেই আমরা তাকে স্বৈরাচারী অগণতান্ত্রিক শাসকবর্গের বিরুদ্ধে দৃশ্য প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখি। সভা- সমিতি এবং শোভাযাত্রা-হরতাল সংগঠনের অভিযোগে ১৯৪৮-এর মার্চ ও সেপ্টেম্বরে দুবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধস্তন কর্মচারীদের ন্যায্য স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে’ ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সে সময়ে আরো কতিপয় আন্দোলনকারী ভবিষ্যতে সৎ আচরণের মুচলেকা দিয়ে নিজেদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করিয়ে নেয়। কিন্তু শেখ মুজিবের কাছে তা ছিল অচিন্ত্যনীয়। তখন থেকেই তার সংগ্রামী চেতনা ও প্রত্যয় সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল। এরপর বহুবার তিনি অতি তুচ্ছ ও মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জীবনের অনেকগুলো বছর কারা প্রাচীরের অন্তরালে অতিবাহিত করেন।
একাধিকবার তাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার চেষ্টা করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়ে, প্রকৃতপক্ষে যা ছিল ‘পিন্ডি ষড়যন্ত্র’ মামলা এবং পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক কারাগারে নিঃসঙ্গ কারাকক্ষে বন্দি, তখনও মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়িয়েও, শেখ মুজিব আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। মুহূর্তের জন্য তিনি আপসকামিতাকে প্রশ্রয় দেননি, সর্বদা তার ইস্পাতকঠিন মনোবল অক্ষুন্ন রেখেছেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়ে তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন; কিন্তু সে অবস্থাতেও তিনি এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হন। কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন, তার কর্মক্ষেত্র বিস্তৃততর হলো এবং তার সাংগঠনিক দক্ষতার দ্রুত বিকাশ ঘটল। মূলত তারই অক্লান্ত এবং কুশলী কর্মোদ্যোগের ফলে ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে নুরুল আমীনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকারের ভরাডুবি ঘটে এবং প্রগতিশীল যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব তখন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হন এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসককুল অবশ্য যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং তারপরই বাঙালির স্বার্থ রক্ষাকারী প্রায় তিন হাজার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে দ্রুত গ্রেফতার করা হয় । শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে কারাগারের প্রবেশ-পথে সহিংস প্রতিবাদ করাসহ নানা অভিযোগ আনা হয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সেদিন পাকিস্তানের শাসকবর্গ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্য আটঘাট বেঁধে আসরে নেমেছিল। প্রায় এক বছর ধরে মামলা চলে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিব তখন আওয়ামী লীগকে দেশব্যাপী আন্দোলনে সুসংহত করার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন ।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পূর্বপর্যন্ত, প্রথমে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার এবং শেষে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত বাঙালির সংগ্রামী সকল তৎপরতায় শেখ মুজিবের ভূমিকা ক্রমাস্বয়ে উজ্জলতর হয়ে উঠতে থাকে। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করলেন। তার এই বিকাশ অন্যান্য সব নেতা থেকে পৃথক করে তাকে এক অভূতপূর্ব মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করে। বিশেষ করে তার অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ করতে হয় । মধ্য ষাটের দশকে তিনি যুগান্তকারী ছয়-দফা’ প্রণয়ন করে এবং ছয়-দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সংহত করেন । ছয়-দফার মধ্যে নিহিত ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বীজ।
দেশের মানুষ অকারণে বা নিছক আবেগের তাড়নায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে বরণ করে নেয়নি। ষাটের দশকের শেষ দিকে উনসত্তরের গণবিক্ষোভসমূহ এবং সত্তরের গণআন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালনা করে শেখ মুজিব যেভাবে দুর্বল জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলেন এবং দেশবাসীর চিত্তে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে তুঙ্গে নিয়ে যান, তা এক কথায় তুলনারহিত। ১৯৭১ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাক কর্তৃপক্ষের হাতে বন্দি হওয়া পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চল, তথা সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন সেই বাংলাদেশের জনগণমন অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের সঙ্গে এক অসাধারণ অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়, যা ব্যাপ্তিতে, শান্তিপূর্ণ প্রয়োগে, দৃঢ়তায় এবং সর্বাত্মক সাফল্যে বিশ্ব ইতিহাসের সামনে এক অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছে ।
আমাদের মনে পড়ে ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের কথা, যা বঙ্গবন্ধুর ‘ছয়-দফা’ আন্দোলনেরই বিজয়। আমাদের মনে পড়ে ১৯৭১ এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসমাবেশের কথা, যেখানে বঙ্গবন্ধুর পরিচালনায় ৪১৭ জন নবনির্বাচিত জাতীয় এবং প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির সদস্য ছয়-দফা এবং এগারো-দফা কর্মসূচির প্রতি তাদের অকুণ্ঠ আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন। আমাদের বিশেষভাবে মনে পড়ে; ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মানুষের সামনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ভাষণের কথা। তিনি দেশবাসীকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা বলেন, যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্রুকে প্রতিহত করার আহ্বান জানান। বলেন যে, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। তিনি যদি নির্দেশদানের জন্য নাও থাকেন, তবুও। বজ্রকণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ।
বঙ্গবন্ধুর ওই ঘোষণাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। তাই তিনি যদি হুকুম দিবার জন্য নাও থাকেন, বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম যেন অব্যাহত থাকে, সে কথা সেদিন তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন। তবে এ কথা তিনি আরো স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে, ইংরেজি দিনপঞ্জি অনুযায়ী তখন ২৬ মার্চ শুরু হয়ে গেছে। সর্বত্র বেতারযোগে পাঠাবার জন্য তিনি একটি বাণী সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে জনৈক বন্ধুকে ডিকটেশন দেন। বিখ্যাত মার্কিন লেখক রবার্ট পেইন তার ‘ম্যাসাকার গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন যে, বাণীটি ছিল নিম্নরূপ: ‘পাকিস্তান সামরিক বাহিনী মাঝরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানার পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। প্রতিরোধ করার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য শক্তি সঞ্চয় করুন। এ প্রসঙ্গে জেনারেল ওসমানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার সালেকের একটি বইয়ের উল্লেখ করে বলেন যে, ঐ রাতে যখন সালেক টিক্কা খানের সঙ্গে বসেছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়্যারলেসে ভেসে আসছিল। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান চট্টগ্রামে তার বিশিষ্ট সহকর্মী জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে পৌছে যায়। ২৬ মার্চ দুপুরের আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণীটি হ্যান্ডবিল আকারে চট্টগ্রাম শহরে বিলি করা হয়। সেই সন্ধ্যাতেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর বরাত দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচারিত হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর ঐ ঘোষণা অনুযায়ীই আমরা ২৬ মার্চ তারিখটিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের স্বাধীনতার মূল স্থপতি, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান সারথি ও অগ্নিপুরুষ। মুক্তিযুদ্ধকালীন একাত্তরের নয় মাস তিনি সশরীরে আমাদের মধ্যে ছিলেন না; কিন্তু রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা এবং অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিকামী বাঙালি জনগণ ঐ নয় মাস তার দৃপ্ত মুখমণ্ডলকে হৃদয়ে স্থান দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে, তার স্লোগান জয় বাংলা’-কে কণ্ঠে ধারণ করে স্বদেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সর্বস্ব পণ করে লড়েছে। তার অনুপস্থিতিতেও তিনি বেঁচে আছেন না নিহত হয়েছেন তা জানার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে, তাকেই বসিয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আসনে। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুই যে জাতির পিতার আসনে আসীন হবেন, এ সত্যটি তখনই সবার চিত্তে দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নিয়েছিল।
এ সত্যটি পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের কাছেও অস্পষ্ট থাকেনি। বঙ্গবন্ধু তার দুর্জয় সাহস, গভীর আত্মবিশ্বাস, প্রবল দেশপ্রেম, দৃঢ় সংকল্প ও নেতৃত্বের বিভিন্ন গুণাবলির কারণে তাদের চোখে হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানতম শত্রু। আইউব খান তাকে আগরতলা মামলার মাধ্যমে ফাঁসি-কাষ্ঠে ঝোলাতে চেয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানও ঘোষণা করেছিলেন যে, মুজিব হচ্ছে পাকিস্তানের শত্রু, তাকে ফাসি কাষ্ঠে ঝোলাতেই হবে। পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকবর্গ কর্তৃক শেখ মুজিবের মূল্যায়ন এবং বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা হিসেবে এ অঞ্চলের আপামর জনগণ কর্তৃক শেখ মুজিবের মূল্যায়ন দুই-ই একবিন্দুতে মিশে তার মাথায় বাংলাদেশের জাতির পিতার শিরোপা পরিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৪ সালের সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি জাতির পিতা বলে উল্লেখ করেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ আরো একটি চমৎকার তথ্য দিয়েছেন তার সাম্প্রতিক রচনায়। তিনি জানিয়েছেন যে, গণপরিষদের সদস্য নাটোরের আশরাফুল ইসলাম মিঞা ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল পরিষদের প্রথম সভাতেই স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সভাকক্ষে কেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নেই সে প্রশ্ন তোলেন এবং প্রস্তাব করেন যে, জাতির পিতার ফটো না দেওয়া পর্যন্ত হাউস মুলতবি রাখা হোক। এরপর উপস্থিত সদস্যদের সমবেত ইচ্ছার ভিত্তিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি হাউসে স্থাপিত হয়। বঙ্গবন্ধু যে জাতির পিতা, গণপরিষদেই তা সেদিন সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয়। পরে বাংলাদেশের সংবিধানেও এর স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি যখন জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত হয়, তখন সংশোধনীর ৩৪ নং অনুচ্ছেদে লেখা থাকে; ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন।
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান জাতীয় সংসদে পঞ্চম সংশোধনী পাস করান, যার মাধ্যমে বলা হয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত যে সকল ফরমান, আদেশ, সামরিক আইন ইত্যাদি প্রণীত হয়েছে এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে সংবিধানের যে সকল সংশোধন, সংযোজন ইত্যাদি করা হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো আদালত বা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো কারণে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এখানে যে বিষয়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, তা এই যে, সামরিক ফরমানে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে জাতীয় দল বিলুপ্ত করা হয়েছিল; কিন্তু ৩৪ নং অনুচ্ছেদ, অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হইবেন, বাতিল করা হয়নি। তাই সাংবিধানিকভাবেও বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, যদিও সমগ্র দেশবাসী জানে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্কিত করে তোলা এই বিষয়টি আসলে মোটেই সংবিধান সম্পর্কিত নয়
মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালিত্বের চেতনাবিরোধী প্রতিক্রিয়ার শক্তিসমূহ নানা কূট-তর্ক তুলে চলেছে তাদের হীন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে। দেশবাসীর মানসপটে বঙ্গবন্ধু দীর্ঘকাল ধরেই জাতির পিতারূপে বিরাজমান। তার সে আসন টলানোর শক্তি কারো নেই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে, নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালি জনগণ যখন আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠেছিল, তখন দেশের অগ্রজ কবি জসীমউদ্দীন ঢাকা রেডিও থেকে স্বকণ্ঠে ‘বঙ্গবন্ধু শীর্ষক স্বরচিত একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। কবিতাটির চরণ ছিল নিমরূপ:
মুজিবুর রহমান
ওই নামে যে বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারি বান…
জীবন দানের প্রতিজ্ঞা লয়ে লক্ষ সেনানী তব পাছে
তোমার হুকুম তামিলের লাগি সাথে তব চলিয়াছে।
রাজভয় আর কারা শৃঙ্খল হেলায় করেছ জয়
ফাঁসির মঞ্চে মহত্ব তব কখনো হয়নি ক্ষয়।
বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূর্ত রাজ
প্রতি বাঙালির হৃদয়ে তোমার তখত তাজ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অভ্যুদয় ঘটল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের; কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, যদিও বিজয়ী বাঙালি স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছে যে এবার তারা তাদের বীর নেতাকে শীঘ্রই নিজেদের মধ্যে ফিরে পাবে। ইতিহাসের অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতার দাবিতে তাদের সে আশা পূর্ণ হতে বেশি দেরি হয়নি। বঙ্গবন্ধু বাংলার মাটিতে, তার মুক্ত স্বদেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। এর আগেই আন্তর্জাতিক তৎপরতা ও পাকিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতির ফলে যখন বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি সুনিশ্চিত হয়ে যায়, তখন সংগ্রামী কবি সিকান্দার আবু জাফর “ফিরে আসছেন শেখ মুজিব’ নামে একটি চমৎকার কবিতা লেখেন। সিকান্দার তখন বাংলাদেশের আরো বহু দেশত্যাগী মানুষের মতো ভারতের পশ্চিম বাংলায় শরণার্থী হয়ে বাস করছিলেন। তার কবিতাটি ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই কবিতার কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করে ‘কেন তিনি জাতির পিতা’ শীর্ষক আমার এই লেখা শেষ করছি :
মুক্তিকামী মানুষের শুভেচ্ছার পথে
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান
ফিরে আসছেন বাংলাদেশ…
করতালি মুখরিত পথে
ফিরে আসছেন তিনি জাতির জনক
সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ…
সূত্রঃ শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সম্পাদনাঃ মোনায়েম সরকার এবং মোহাম্মাদ হাননান
Leave a Reply