চার ক্লাসের পর আর স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি। গরু-মহিষ চরিয়ে দিন যেতো। দশ বছর বয়সে বিয়ে হলো ৩০ বছরের এক লোকের সাথে। ১৯ বছর বয়সে হলেন তিন সন্তানের মা। এই সময় ঘটলো জীবনে সবচেয়ে বেদনাদায়ক মর্মান্তিক এক দূর্ঘটনা। যৌতুকের পণ দিতে না পারায় তিনি স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হলেন। দুশ্চিরিত্রা হিসাবে বদনামের ভাগী হলেন। নির্মম প্রহারের আঘাত সহ্য করতে না পেরে মূর্ছা গেলে স্বামী মনে করেছিলো- মনে হয় মারাই গেছে। গোয়ালঘরে যখন তাকে টেনে হিঁচড়ে আনা হলো তখন তিনি সন্তানসম্ভবা। সেই গোয়ালঘরেই তাঁর কন্যা সন্তানের প্রসব হয়। নিজের নাড়ী নিজেই কাটেন।
স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হলেন। বাপের ঘরে আশ্রয় মিললোনা। সমাজে ঠাঁই হলোনা। আশ্রয় নিলেন শশ্মানে। খাবার জুটতো শশ্মানে। শবদেহ পোড়ানোর পর কিছু খাবার ছিটিয়ে দেওয়া হতো। সেসব খেয়েই ক্ষুধা নিবৃত হতো। সমাজে বেরতে চাইলে শশ্মানের ভূত বলে মানুষ মা আর মেয়েকে তাড়িয়ে দিতো।
জীবন থেকে মুক্তিপেতে সুইসাইড করার জন্য রেললাইনে শুয়ে থাকলেন। ট্রেন এলোনা। তিনি জানতেন না সেদিন রেল ধর্মঘট। শ্মশানে ফিরে আসলেন। মেয়ে বুঝতে পারে মা তাকে নিয়ে মরতে চাইছে। সে পালাতে চায়। পরের সপ্তাহে আবার মেয়েকে আঁচলের সাথে বেঁধে শুয়ে পড়লেন রেললাইনের ওপর। এমন সময় শোনেন প্রচণ্ড কান্নার শব্দ। কী মনে করে মাথা তুলে দেখেন গাছের নীচে বসে একটা শিশু কাঁদছে।
তিনি দেখেন গাছের একটি ডাল কোনো রকমে ভেঙে পড়তে পড়তে গাছের সাথে লেগে আছে। সেই ভাঙ্গা ডালেই আবার পাতা হয়েছে। ফুল ফুটেছে। সেই ভাঙ্গা ডালের ছায়ায় বসে ছেলেটি কাঁদছে।
তিনি ভাবলেন ভেঙ্গে যেতে যেতে টিকে থাকা গাছে যদি পাতা গজায়, ফুল ফোটে, সেই ভাঙ্গা গাছের ডাল আবার ছায়া দিয়ে মানুষকে আশ্রয় দেয় তবে তার এই জীবনটা কি শুধুই অর্থহীন। এগুলো কি বিশেষ কোনো ইংগিত।
এক হাতে ছেলে আরেক হাতে মেয়েকে নিয়ে তিনি রেলস্টেশানে আসলেন। ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজে খাওয়ালেন। কাজ খুঁজে কাজ পেলেন না। স্টেশানে গান গেয়ে ভিক্ষা করা শুরু করলেন। যত টাকা আয় হতো সেগুলো দিয়ে খাবার কিনে রাতে রান্না করেন। শিশুদুটোকে নিয়ে খান। রেলস্টেশনে ঘুমিয়ে থাকে অন্যান্য শিশুদের নিয়ে এসেও খাওয়ান। ঘুম পাড়ান। স্নান করান। পিতামাতাহীন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিশুগুলোও যেন মাকে খুঁজে পায়। মাতৃত্বের চির শ্বাসত রুপ তাকে আরো মানবীয় করে তোলে।
এর মাঝে ঘটে আরেক ঘটনা। একটি ব্রিফকেস খুঁজে পেয়ে স্টেশান মাস্টারের অফিসে জমা দেন। লোকটি ভালো মানুষ ছিলো। কয়েক সপ্তাহ পর ভদ্রলোক দেখা করতে এসে তাকে উপহার দিতে চায়। তিনি বলেন কোনো উপহার চাইনা। শুধু আমার শিশুদের নিয়ে থাকার জন্য একটা ঘর বেঁধে দিন। শুরু হলো তার জীবনের আরেকটি অধ্যায়। অনাথ শিশুদের নিয়ে থাকার একটা ঘর পেলেন। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। শিশুদের প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা দেখে অন্যান্য মানুষেরাও এগিয়ে আসলো। ঘর বড় হলো। যাদের পৃথিবীতে কেউ নেই এসব শিশুরা তাঁর কাছে আশ্রয় পেলো। অনাথ শিশুরা নতুন এক মা খুঁজে পেলো। এরপর কেটে গেছে অনেকদিন । প্রায় হাজার অনাথের ঠিকানা হলো তাঁর কাছে ।
একদিন দেখেন একজন বৃদ্ধ, জীর্ণ শীর্ণ লোক তার কাছে এসে আশ্রয় চাইছে। ভাত, রুটি যাই থাকুক না কেন এতোটুকু খাবার চাইছে। বৃদ্ধ লোকটিকে তিনি আশ্রয় দিলেন। স্নান করালেন। গায়ের জামা বদলে দিলেন। খাবার খাওয়ালেন। ডাক্তার এসে তার শরীর চেক করে ঔষধ খাইয়ে গেলো। বৃদ্ধ লোকটি তাকে চিনলোনা। কিন্তু তিনি নিজে চিনতে পেরে বললেন- একদিন তুমি এক সন্তানসম্ভবা মেয়েকে মেরে গোয়ালঘরে ফেলে রেখেছিলে। কিন্তু বিধাতার কি নিয়ম দেখো আজকে তুমি সেই মেয়ের কাছেই আশ্রয়ের জন্য এসেছো। শশ্মানে শবের অপেক্ষায় থেকে দুমুঠো খাবারের জন্য যার জীবনে কেটেছে সে জানে খিদের কষ্ট কি। সে জানে মাথার উপর একটু আশ্রয় প্রাপ্তির সুখ কি। তাই তুমি সব কিছুই এখানে আমার কাছে পাবে। কোনো অবহেলা হবেনা। তবে তুমি আর আমার স্বামী হিসাবে না । বরং আমার সন্তান হিসাবেই এখানে থাকবে।
পুরো বিশ্ব থেকে তিনি নানা সম্মান, খ্যাতি এবং প্রায় ৭৫০ টি নানা রকমের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। “মাদার অব থাউজেন্ড অরফ্যানস” নাম দিয়ে সার্চ করলে এই মহিয়ষী নারী ড. সিন্ধুতাই সপকালকে নিয়ে লেখা অসংখ্য আর্টিকেল উঠে আসে।
গোয়াল ঘরে জন্ম নেয়া তাঁর মেয়েটি চিকিৎসক হয়ে সব অনাথদের চিকিৎসার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। তাঁর অনাথ আশ্রম থেকে শত শত ডাক্তার , ইন্জিনীয়ার হয়ে শুধু ভারতে না, বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এই মহিয়ষী নারী এবার করোনার এই ডিজাস্টারের সময় যাতে একজন মানুষও তার এলাকায় অভুক্ত না থাকেন তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। বিবিসির সাংবাদিককে বলেন বড় চিকিৎসক, বড় প্রযুক্তিবিদ হওয়া অবশ্যই ভালো । কিন্তু এসব না হলে যে মানুষের সেবা করা যায়না তা ঠিক নয়। চারপাশ থেকে যা পেলাম তা শুধু নিজের করেই নিলাম এরকম মানুষ যতবড় বিত্তশালী হোক না কেন তাতে সমাজের কোনো লাভ হয় না। মানুষের সেবা করার জন্য সুন্দর একটা ত্যাগের মন থাকাটাই যথেষ্ঠ। গহনা, অলংকার, পোষাক পরিচ্ছদের কথা বলতে গিয়ে হেসে বলেন মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে বড় অলঙকার আর কিছুই নেই। সততার চেয়ে দামি পরিচ্ছদও আর নেই ।
আপনার এতো সুন্দর চিন্তা, ভাবনাকে শ্রদ্ধা জানাই। হাজার সন্তানের জননী আপনাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে অভিবাদন।
২০২২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পদ্মশ্রী সম্মানে ভুষিত এই নারী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭৪ বছর।
এ জাতীয় আরো খবর..
Leave a Reply