“আমি শুনেছি সেদিন তুমি
সাগরের ঢেউয়ে চেপে
নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো”।
মৌসুমী ভৌমিকের এই গানটি খুবই চমৎকার লাগে। শুধু আমার নয় অনেকেই এ গানটাকে খুব পছন্দ করেন। সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্তকে ছুঁয়ে আসাটা সত্যিই দারুণ। সাগরের নীল জল ব্যাপারটি আমাকে বেশ ভাবায়। সাগরে অনেকবার গেছি। নীল জল দেখেছি। কিন্তু কবিতায় বা গানের নীল জল, কিংবা অনেক ছবিতে সমুদ্রের নীল স্বচ্ছ জল দেখেছি। আর ভেবেছি এতো নীল জল কি সত্যিই হয়! এসব প্রশ্নের উত্তর যেমন মিললো, তেমনি স্বচক্ষে অপূর্ব নীল জল দেখার সুযোগও মিললো!
গত ১০ ডিসেম্বর,২০২৩ এ হালকা শীতের সকালে বাংলাদেশ বিমানে চড়ে চলে গেলাম ব্যাংককের সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। সেখান থেকে সেদিনই অভ্যন্তরীন এক বিমানে ফুকেট। লক্ষ্য নীল জল সমুদ্র দেখবো। হোটেলটাও ছিল পাতং বীচ এলাকায়। যথারীতি একদিন আসপাশের কিছু চমৎকার জায়গা দেখলাম এবং রাতে ‘ফি ফি আইল্যান্ড’ এর একটি প্যাকেজ ট্যূর বুক করলাম।
সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, বৈকালিক নাস্তা সহ আানলিমিটেড পানীয়(পানি, নানা রকম জুস এবং সফট ড্রিংক্স)প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সকাল ৭.৩০ এ হোটেল থেকে আমাদেরকে ট্যাক্সিতে পিক করে। নির্ধারিত ঘাট থেকে নাস্তা ও কফি খেয়ে বুটে যাত্রা শুরু। খুব সুন্দর একটা ইঞ্জিন বুট। ২০ জনের মতো ধারণক্ষমতা থাকলেও এই প্যাকেজটি একটু দামী হওয়াতে মোট মানুষ ছিলাম ১৩/১৪ জনের মতো। বুটে উঠার সময়ই অভুতপূর্ব শিহরন অনুভব করলাম। সত্যিই নীল জল আর তাও এত স্বচ্ছ যা অবিশ্বাস্য ও স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর চারদিকে নীল জলরাশি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। আমি অপলক চেয়ে দেখছি আর বুটটি তরতর করে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ যাওয়ার পর ধীরে ধীরে দূরে চোখে পড়তে থাকলো ছোট ছোট পাহাড়ী দ্বীপ। সমুদ্রের মাঝে মাঝে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা পাহাড়। বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছি সরাসরি ঐ সব পাহাড়ি দ্বীপে নেমে ঘুরাঘুরির জন্য।
সারাদিনের এই ট্যূরটিতে বেশ কয়েকটি স্পটে স্টপেজ ছিল। এর মধ্যে ফিফি ডন আইল্যান্ড, মায়া বে, মানকি কেইভ, ব্যাম্বো আইল্যান্ড, কাই আইল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। আরও দুএকটি জায়গায় স্টপেজ ছিল। কোন কোন স্থানে বীচে নেমে ঘুরাঘুরির সুযোগ ছিল। অপরূপ প্রকৃতি উপভোগ করা আর ছবি তোলা ছিল আনন্দের। আমাদের গাইড এক পাহাড়ের কাছাকাছি গিয়ে বুট থামিয়ে বললো এটা মানকি কেইভ। এখানে ছবি তুলতে পারবেন। তবে সতর্ক থাকতে হবে যে আমরা যেন বানরের নাগালের মধ্যে না থাকি। মাঙ্কি কেইভ নামেই যার পরিচয়। সেখানে পাহাড়ের গুহায়, ফাঁক ফোকরে অনেক বানর দেখা যায়। ঐ পাহাড়ের কাছাকাছি বুট থেকে কিছু ছবি তোলার চেষ্টা করেছি। আন্দামানের নীল জল সমুদ্রের মাঝে মাঝে দ্বীপাঞ্চল। সুউচ্চ পাহাড়। কোনটা নিরেট পাথুরে মাটি। আর পাহাড়ে নানা রকম সবুজ বৃক্ষরাজী। এত গভীর সমুদ্রের মাঝে মাঝে হঠাৎ সুউচ্চ পাহাড় যার সৌন্দর্যে যেমন বিমোহিত হয়েছি। তেমনি প্রকৃতির এই খেয়ালে সমানভাবে বিস্মিতও হয়েছি। আল্লাহর কী অপার মহিমা! এক স্থানে পাশাপাশি উঁচু উঁচু দুটি পাহাড়; মধ্যখানে অথৈজল। যত দেখছি ততই বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। শরৎ চন্দ্রের মতো বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, “ভগবান এই চোখ দুটো যেমন দিয়েছিলে তেমনি আজ তা স্বার্থক করলে”।
মাঙ্কি কেইভ ছাড়া অন্য দ্বীপগুলোতে নামার সুযোগ হয়েছিল। মায়া বে তে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে অনেকদূর হেটে যাওয়া যায়। বিভিন্ন স্থানে বীচে নেমে নীলজলে পা ভিজিয়েছি। হেটেছি অনেকদুর। সেখানে এক স্থানে একটু গভীর জলে হাঙ্গর দেখা যায়। আমরাও দেখেছি। গাইড সাবধান করেছিল কোন ভাবেই যেন ওদের বিরক্ত করা না হয়। ছবি তুলতে গেলেও যেন যথযথ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। যদিও এ ধরনের দূর্ঘটনার কোন রেকর্ড নেই। তবুও শার্ক বলে কথা। এটা একটা হিংস্র প্রাণী। আমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম ঠিক একটু পেছনেই একটি ছোট্ট শার্ক জলের নীচে ঘুরতে দেখা গেছে। ভয়ে দ্রুত সরে এসেছি। তখনও অস্পষ্ট দেখলাম সেই প্রাণীটিকে। কিন্তু সেভাবে ছবিতে ধারন করতে পারিনি হয়তো।
ব্যাম্বো আইল্যান্ডে আমাদের জন্য মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা ছিল। চমৎকার এই দ্বীপটি। অনেক সমতল জায়গা আছে। বীচও বেশ দীর্ঘ। ঝাউগাছ আর অন্যান্য কিছু ঝোপ জাতীয় গাছ মিলে বেশ পীতাব সবুজের সমাবেশ। যতটুকু জানতে পেরেছি দূর থেকে ভিউটা অনেকটা বাঁশ ঝাড়ের মতো। তাই একে ব্যাম্বো আইল্যান্ড হিসাবে ডাকা হয়। চমৎকার খাবার দিয়েছে ওরা। খেতে বেশ সুস্বাদু ছিল। থাইল্যান্ডে আমাদের পছন্দের খাবার তেমন মিলে না। তাই সন্তুষ্ট চিত্তে খেয়ে বেশ খানিকক্ষণ বীচে কাটিয়ে আবার যাত্রা। এখানেই সবথেকে বেশি সময় সাদা বালিতে হেটেছি। প্রতিটা বীচেই জল যেমন নীল তেমনি বীচের বালি খুব মিহি এবং সাদা। এর পর কাই দ্বীপ সহ আরও কয়েকটি স্থানে আমরা নেমেছি। আমি যদিও সাতার কাটিনি। কালো বা ব্রাউন চামড়ার আমরা দুজন মাত্র ছিলাম। বাকী সবাই সাদা চামড়ার। নারী পুরুষ নির্বিশেষে খুবই সংক্ষিপ্ত পোষাকে সারাক্ষণ সমুদ্রস্নানের জন্য তৈরি হয়েই থাকে। আর তীরে সময় পেলে সান বাথ উপভোগ করা কোনভাবে কারও বোধ হয় বাদ যায় নি। সবারই লাইফ জ্যাকেট পড়ে জলে সাতার কেটেছে। ডাইভিং করেছে। যতরকম ভাবে পারা যায় ওরা সমুদ্র আর দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করেছে। অত্যন্ত চমৎকার ভাবে দিনটা অতিবাহিত করেছি। ঘাটে এসে নামলে আবার ট্যাক্সি যোগে হোটেলে ড্রপ করেছে। একটা দারুণ অনুভূতি, একটা অভাবনীয় ভালো লাগা নিয়ে নীল জল সমুদ্রের কল্পনাকে বাস্তবে স্পর্শ করে ঘরে ফেরা। যতদিন মনে থাকবে ততদিনই এই ভালোলাগার অনুভূতিটুকুও মনে থাকবে। এখনও মনে হয় চোখের সামনে সব কিছু দেখতে পাচ্ছি। আমি এই স্মৃতিটুকু লালন করতে চাই খুবই যতনে। আমার বর্তমান এক কলিগ স্নেহাস্পদ নোমান আমাদের এই ভ্রমনের প্ল্যানিং থেকে শুরু করে সফল বাস্তবায়নের জন্য যা কিছু করণীয় সবই করেছে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
Leave a Reply